আফিল উদ্দিন আমার বড় ভাই, তবে আমরা ভিন্ন মতাদর্শের: শেখ বশিরউদ্দীন
আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনের ৩ স্ত্রীর ১৫ সন্তানের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন। আরেকজন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
প্রয়াত সেখ আকিজ উদ্দিন ১৯৯৯ সালে সন্তানদের মধ্যে ব্যবসা ভাগ করে দেন। সেই থেকে আফিল উদ্দিনের সঙ্গে শেখ বশিরউদ্দীনের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। তাঁদের পারিবারিক যোগাযোগও খুব বেশি নয়। ২০২৩ সালে শেখ বশির যখন নিজের আকিজবশির গ্রুপের যাত্রা শুরু করেন, তখন আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসেননি শেখ আফিল।
শেখ বশির গত রোববার বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। তার পর থেকে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিলের ভাই হিসেবে ধরে শেখ বশিরকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দেওয়া হচ্ছে; যদিও শেখ বশির সম্পর্কে জানাশোনা থাকা ব্যবসায়ীরা বলছেন, শেখ আফিল ও শেখ বশিরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। শেখ বশির ব্যবসায় মনোযোগী ছিলেন। আফিল ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে গত সোমবার শেখ বশির সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমার ধারণা, ওনারা মিস ইনফরমড (ভুল তথ্য পাওয়া)। ওনাদের তথ্যের ভিত্তি সঠিক নয়।’
যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে দেওয়া এক বিবৃতিতে শেখ বশির বলেন, ‘আফিল উদ্দিন আমার বড় ভাই। আমরা আলাদা মায়ের হলেও বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করে চলি। তবে রাজনৈতিক আদর্শে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্নমতাদর্শের।’
শেখ বশির আরও বলেন, ‘ভিন্ন মা হওয়ায় ১৯৯৯ সালে পারিবারিকভাবে আমরা আলাদা হই। পরে আফিল ভাই রাজনীতিতে যুক্ত হন। আমরা সবাই দীর্ঘদিন ধরেই আলাদা ব্যবসা পরিচালনা করছি। তিনি মূলত যশোরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ও রাজনীতি করছেন। আমিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা ঢাকাকেন্দ্রিক।’
সেখ আকিজ উদ্দিনের ১৫ সন্তানের মধ্যে ১০ ছেলে ও ৫ মেয়ে। আকিজ উদ্দিনের সন্তানদের মধ্যে ছেলেরাই শুধু ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। ১০ ছেলের মধ্যে ব্যবসা ভাগ করে দেন আকিজ উদ্দিন নিজেই। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
সেখ আকিজের প্রথম স্ত্রীর তিন ছেলে। এর মধ্যে শেখ মহিউদ্দিন চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী। তিনি আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালনা করেন। শেখ মমিন উদ্দিন ২০২০ সালে মারা গেছেন। তিনি ট্যানারি, চামড়াসহ বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। শেখ আকিজের প্রথম স্ত্রীর তৃতীয় ছেলে শেখ আফিল উদ্দিন। তাঁর আফিল গ্রুপ নামে ব্যবসা আছে। সেটা মূলত যশোর এলাকায়।
সেখ আকিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই ছেলে শেখ আমিন উদ্দিন ও শেখ আজিজ উদ্দিন। শেখ আমিনের তথ্যপ্রযুক্তি, গাড়িসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। শেখ আজিজের পুঁজিবাজার–সংশ্লিষ্ট খাত, কৃষিসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে।
সেখ আকিজের তৃতীয় স্ত্রীর পাঁচ ছেলে। তাঁরা হলেন সেখ নাসির উদ্দিন, শেখ বশিরউদ্দীন, শেখ জামিল উদ্দিন, শেখ জসিম উদ্দিন ও শেখ শামীম উদ্দিন। এই পাঁচ ভাই ২০২২ সাল পর্যন্ত একত্রে ব্যবসা করেছেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল আকিজ গ্রুপ। পরে তাঁরা ব্যবসা ভাগাভাগি করেন। তবে এখনো ধানমন্ডির একটি বাড়িতে পাঁচ ভাই পরিবারসহ একত্রে বসবাস করেন।
সেখ নাসির উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের আকিজ অ্যাসেট, শেখ বশিরউদ্দীনের প্রতিষ্ঠানের নাম আকিজবশির গ্রুপ, শেখ জামিল উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের নাম আকিজ-ইনসাফ গ্রুপ, শেখ জসিম উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের নাম আকিজ রিসোর্সেস এবং শেখ শামীম উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের নাম আকিজ ভেনচার।
২০২৩ সালের মার্চে আকিজবশির গ্রুপের যাত্রা শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আকিজবশির গ্রুপের অধীন রয়েছে সিরামিকস, স্যানিটারি ও বাথওয়্যার, টেবিলওয়্যার, পার্টিকেল বোর্ড, পাট, স্টিল, চা-সহ ১৬ ধরনের ব্যবসা। বছরের এসব ব্যবসার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার।
নতুন গ্রুপের নবযাত্রার এ ঘোষণা অনুষ্ঠান মঞ্চে শেখ বশিরউদ্দীন হাজির হন তাঁর বাবা সেখ আকিজ উদ্দিনের ব্যবহৃত ভেসপা মোটরসাইকেলে করে মাকে সঙ্গে নিয়ে। এ সময় তিনি জানান, নতুন এ গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন তাঁর মা মনোয়ারা বেগম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, শেখ বশির সব সময় রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেও তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তিনি মূলত একজন নিরেট ব্যবসায়ী। শেখ বশির অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিয়েছেন—এটাই অনেককে অবাক করেছে।
খুলনার ফুলতলা থেকে উঠে আসা শিল্পপতি সেখ আকিজ উদ্দিন শূন্য থেকে শুরু করে আকিজ গ্রুপকে গড়ে তুলেছিলেন। ছেলেদের মধ্যে তিনি শেখ বশিরউদ্দীনকে ১৯৮৮ সালে ব্যবসায় নিযুক্ত করেন। তখন তিনি মাত্রা ম্যাট্রিক পাস করেছেন। পদ ছিল স্টেশনারি খরিদকারী। পরে বশিরউদ্দিন তেজগাঁও কলেজের নৈশ শাখা থেকে বিকম পাস করেন। তিনি আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছিলেন। পরে নিজের প্রতিষ্ঠান আকিজবশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন তিনি। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগে ব্যবসার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি।