যে কারণে পণ্যের দাম ঠিক করে দেবে সরকার
না মানলে আইনে তিন বছরের জেল বা কোথাও কোথাও আরও বেশি জেল-জরিমানার বিধান আছে। সরকার ‘শক্ত অবস্থানে’ যেতে চায়।
এখন থেকে নয়টি পণ্যের দাম ঠিক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পণ্যগুলো হচ্ছে চাল, গম (আটা, ময়দা), ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, এমএস রড ও সিমেন্ট। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) প্রতি মাসে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণের কাজ করবে।
সচিবালয়ে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত বৈঠকে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের কথা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে দ্বিমত জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের পর সাংবাদিকেরা সচিবালয়ে বিষয়টি কৃষিমন্ত্রীর নজরে আনলে তিনি বলেন, অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্ব হচ্ছে, পণ্যের দাম ঠিক হয় সরবরাহ ও চাহিদার ওপর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আর চাল তো আমদানি হচ্ছে, খোলাবাজারেও যাচ্ছে। এতেই দাম কমবে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বৈঠকে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, বিটিটিসি চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফুল হাসান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, চট্রগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বিটিটিসির পক্ষ থেকে নয়টি পণ্যের ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনা করা হয়। এতে দেখানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে খোলা আটা ও ময়দা ৬৭ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৬৪ শতাংশ এবং প্যাকেট ময়দা ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।
এ ছাড়া দেশের বাজারে চিনির দাম এক বছরে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। একইভাবে এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে তা বেড়েছে মান ভেদে ২৯ থেকে ৩৯ শতাংশ। এমএস রডেরও একই অবস্থা। এক বছরে স্টিল স্ক্র্যাপের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ। দেশের বাজারে ৬০ গ্রেডের রড ১৫ শতাংশ এবং ৪০ গ্রেডের রড ১৬ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া সিমেন্টের দাম বেড়েছে এক বছরে ৩১ শতাংশ।
অর্থাৎ দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে যতটুকু বাড়ছে, দেশের বাজারে বাড়ছে তার চেয়েও অনেক বেশি হারে। এ বিষয়টিই পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
নির্ধারণ করে দেওয়া দামের বাইরে কেউ পণ্য বিক্রি করলে শুধু জরিমানা নয়, এখন থেকে মামলাও করা হবে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও সবকিছু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা নয়। যেমন চাল খাদ্য মন্ত্রণালয় বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পণ্য। মাঝখানে ডিমের দাম বেড়েছে। এটা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ মুহূর্তে নয়টি পণ্য ঠিক করা হয়েছে। এর বাইরেও যদি নিত্যপণ্য কিছু থাকে, তা–ও আনা হবে। বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে রড, সিমেন্ট ও ডিম নিয়ে। ডিম নিয়ে যে আলোচনায় বসতে হবে, তা ধারণায়ও ছিল না। বৈঠকে আলোচনা হয়েছে দাম কীভাবে যথার্থ করা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের উচ্চমূল্য, দেশের ব্যবসায়ীদের সুযোগ নেওয়া—এসব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবের কারণে অনেক সময় কিছু পণ্যের দাম হয়তো কমানো যাবে না। তবে যেটা হওয়া উচিত, তার থেকে বেশি দামে যেন ভোক্তাদের কিনতে না হয়, সেটি দেখা হবে।’
কত দিন পরপর দাম নির্ধারণ করা হবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতি মাসে একবার করে আমরা পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করব। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে কতটুকু বাড়বে, সেটিও ঠিক করে দেওয়া হবে। বিটিটিসি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কাজটি শুরু করবে।’
নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ দাম বেশি রাখলে সোজাসুজি মামলায় চলে যেতে হবে—এমন মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আইনে তিন বছরের জেল বা কোথাও কোথাও আরও বেশি জেল-জরিমানার বিধান আছে। আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে চাই। যারা সঠিকভাবে ব্যবসা করবে, তাদের উৎসাহিত করব। অন্যায় করলে ব্যবস্থা নেব।’
ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অভিযানে খালি জরিমানা করা হচ্ছে। আমি বলেছি, জরিমানা বাদ। মামলা করতে হবে এবং জেলে ঢোকাতে হবে। আদালতে বিচার হবে। দেখা গেল, দুই লাখ টাকা লাভ করলেন, ৫০ হাজার জরিমানা হলো। তিনি তো মনের আনন্দে থাকবেন যে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোজ্যতেলের দাম এ পর্যন্ত তিনবার কমানো হয়েছে। মজার (ইন্টারেস্টিং) বিষয় হচ্ছে সয়াবিন তেল আমদানি হয় ৩৫ শতাংশের মতো। ৬৫ শতাংশ আমদানি হয় পাম তেল। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কিছুটা কমলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার এ বিষয়ে সতর্ক আছে। কিছুদিন পরপর দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে চাল আমদানির ওপর থেকে কিছু শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামও কমানো হয়েছে কিছুটা। ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা এবং দেশীয় শিল্প সুরক্ষার নামে যাতে কেউ অনৈতিক সুযোগ নিতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হবে।