দেবীর ঘোটকে বিদায়, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব
ঢাকের বোল, কাঁসরের ঘণ্টা, শাঁখের ধ্বনি আর পুণ্যার্থীদের সমাগমে পাঁচ দিন ধরে জমজমাট হয়ে থাকা পূজামণ্ডপগুলো নীরব হয়ে পড়ে আজ মঙ্গলবার মধ্যাহ্নের পর থেকে। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাঙালি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। গত শুক্রবার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল পাঁচ দিনের এই উৎসব। এবার সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার মণ্ডপে পূজা হয়েছে। রাজধানীতে পূজা হয়েছে প্রায় আড়াই শ মণ্ডপে।
আজ বিজয়া দশমীর পূজা শুরু হয় সকাল নয়টায়। রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন মন্দির সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পূজারি শেখর লাল গোস্বামী এবং সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির পূজা পরিষদের সহসভাপতি অঞ্জন নন্দী প্রথম আলোকে জানান, দশমী পূজার লগ্ন ছিল সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট পর্যন্ত। এর মধ্যেই বিভিন্ন মন্দিরে দশমীর বিহিত পূজা সম্পন্ন হয়েছে। এরপর দর্পণ বিসর্জনের ভেতর দিয়ে পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। দর্পণ বিসর্জনের ভেতর দিয়েই মূলত দেবী দুর্গার বিসর্জন সম্পন্ন হয়।
শেখর গোস্বামী জানালেন, এবার দেবী এসেছেন ঘোটকে, গেছেনও ঘোটকে। এর তাৎপর্য হলো বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে, শস্য হানিরও আশঙ্কা রয়েছে। তবে দেবীর চরণে অঞ্জলি দিয়ে শান্তি আর কল্যাণই কামনা করেছেন।
দর্পণ বিসর্জনের পর রাজধানীর বিভিন্ন মন্দিরে বিবাহিত নারীরা সিঁদুর খেলায় অংশ নেন। ঢাকায় সাধারণত স্থায়ী মন্দিরগুলোতেই সিঁদুর খেলার আয়োজন হয়ে থাকে। তরুণীরা সিঁদুর খেলায় অংশ না নিলেও দেবীকে বিজয়ার প্রণাম জানাতে অনেক তরুণী ও তরুণ মন্দিরগুলোতে আসেন। তাতে বিজয়ার বিষাদের মধ্যেও মিশে থাকে আনন্দের আবহ।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে আজ সাকালে গিয়ে দেখা গেল, লাল-সাদা শাড়ি পরে শত শত গৃহিণী বরণডালা ও সিঁদুরের কৌটা নিয়ে মেতেছেন দেবীর চরণ স্পর্শ করে সঙ্গী বা উপস্থিত অন্য ভক্তদের কপালে কপালে সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়ায়।
শান্তিনগর থেকে বরণডালা নিয়ে আসেন শান্তা ঘোষ। তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ প্রকৌশলী, কাজ করেন মেট্রোরেলে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল শহরের কাঠপট্টিতে। সাধারণত বরিশালেই যান পূজার উৎসবে। স্বামীর কাজের চাপ বেশি, তাই এবার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। স্বামী সংসারের কল্যাণ কামনায় বরণডালা সাজিয়ে এনেছেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে। তিনি জানালেন, বিসর্জনের পর এই সিঁদুর খেলা মূলত বিবাহিত নারীদের একটি মাঙ্গলিক আচার। স্বামী-সংসারের মঙ্গল কামনা করে সবাই বরণডালা সাজিয়ে বা সিঁদুরের কৌটা সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই সিঁদুর দেবীর চরণ স্পর্শ করিয়ে কৌটায় করে সংরক্ষণ করেন। এই সিঁদুরই তাঁরা সারা বছর ব্যবহার করেন। যাঁরা বরণডালা সাজিয়ে আনেন, তাতে থাকে ধান, দূর্বা, বেলপাতা, কাঁচা হলুদ, কড়ি, যেকোনো ধরনের অন্তত একটি ফুল, নাড়ু আর মিষ্টি। আর সিঁদুরের কৌটা তো থাকেই। এই বরণডালা নিয়েই দেবী প্রণাম করে ঘরে ফেরেন তাঁরা।
কাকরাইল থেকে লীলাময়ী এসেছিলেন বোন লক্ষ্মী প্রিয়া, আর ইস্কাটন থেকে বৌদি মণিকা রানীকে সঙ্গে নিয়ে। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে দেবী চরণে বরণডালা থেকে অঞ্জলি দিয়ে তাঁরা পরস্পরের মুখে-কপালে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়ে সেলফি তুলছিলেন প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে। লীলা জানালেন, তাঁদের বাড়ি ঢাকাতেই। প্রতিবছর বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে ঘুরে সিঁদুর খেলায় অংশ নেন। গতবার বিজয়ায় রমনা কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন, এবার এসেছেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে।
ফার্মগেটের খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনের পাশে বাঁশ-কাঠসহ সম্পূর্ণ স্থানীয় দেশি উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল পূজামণ্ডপ। এই পূজার আয়োজন করে সনাতন সমাজ কল্যাণ সংস্থা। দশমী পূজার পরে এখানে সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে প্রচুর পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটে। লালমাটিয়া থেকে এসেছিলেন শিউলি সরকার ও তাঁর প্রতিবেশী অর্পণা চৌধুরী। তাঁরা দেবীর চরণে সিঁদুর স্পর্শ করিয়ে পরস্পরকে রাঙিয়েছিলেন সেই সিঁদুরে। অপেক্ষা করছিলেন প্রতিমা বিদায়ের মুহূর্তের জন্য। তাঁরা বললেন, এক বছরের জন্য দেবী চলে যাচ্ছেন। তাই মনটা তাঁদের ভার হয়ে আছে বিষাদে। প্রতিমা বিদায় দিয়ে তারপর ঘরে ফিরবেন।
এই পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার মজুমদার বললেন, এবার তাঁরা মণ্ডপ তৈরি ও সাজসজ্জায় দেশি ও পরিবেশবান্ধব উপকরণের প্রাধান্য দিয়েছেন। পূজায় প্রতিদিনই প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নবমীর দিনে বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
সব মন্দির থেকে প্রতিমা প্রথমে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আনা হয়। এরপর সেখান থেকে সব প্রতিমা নিয়ে পুরান ঢাকার দিকে বিসর্জনের প্রধান শোভাযাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যায় বিসর্জন হয়েছে বুড়িগঙ্গায় ‘বিনয় ঘাটে’। এটি সোয়ারী ঘাটের পাশেই। সাধারণত এই ঘাটেই হয়ে থাকে দেবীর ভাসান।