মেট্রোরেলের কার্ডসংকট: একক যাত্রায় চালু হচ্ছে কাগজের টিকিট
মেট্রোরেলের ভাড়া পরিশোধের কার্ডের সংকট ভোগান্তি সৃষ্টি করছে যাত্রীদের। একক যাত্রার কার্ড না থাকায় অনেক স্টেশনে যাত্রীদের ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার সরবরাহ না থাকায় স্থায়ী কার্ড বা এমআরটি পাস বিক্রিও একেবারে বন্ধ। এ অবস্থায় একক যাত্রার কার্ডের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। তবে স্থায়ী কার্ডের সরবরাহ কবে হতে পারে—এর উত্তর নেই।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র বলছে, এখন তাদের হাতে একক যাত্রার টিকিট কার্ড আছে মাত্র ৩০ হাজারের মতো। এ মাসে আরও ৩০ হাজার কার্ড আসবে। জানুয়ারির শেষ দিকে আসতে পারে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো কার্ড। এরপরও একক যাত্রার টিকিট কার্ডের সমস্যা মিটবে না বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
ডিএমটিসিএলের হিসাবে, মেট্রোরেলে এখন দিনে প্রায় সাড়ে তিন লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। গড়ে ৪৫ শতাংশ যাত্রী একক যাত্রার কার্ড ব্যবহার করেন। অন্যরা যাতায়াত করেন এমআরটি কার্ডে। একক যাত্রার কার্ডসংকটে যাত্রীদের স্টেশনে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করে ট্রেনে উঠতে হচ্ছে। অনেকে কার্ড না পেয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যে যাচ্ছেন।
একক যাত্রার যাত্রীদের সমস্যা ডিসেম্বরের মধ্যেই কেটে যাবে। যাত্রীদের ভোগান্তি এড়াতে সব চেষ্টা চলছে।আবদুর রউফ, ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
গত সপ্তাহে অনেক স্টেশনে আনসার সদস্যরা এমআরটি কার্ড আছে কি না, তা জিজ্ঞাসা করে যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছিলেন বলে জানা গেছে। শেওড়াপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ওঠা সাবরিনা আলম নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আনসার সদস্যরা গেটে দাঁড়িয়ে একক যাত্রার যাত্রীদের প্রবেশে নিরুৎসাহিত করছেন বা ‘না’ করে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, “একক যাত্রার কার্ডসংকট। তাই যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।”’
ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, শুরু থেকেই মেট্রোরেলের কার্ড সরবরাহ করছে জাপানের নিপ্পন সিগন্যাল কোম্পানি। প্রথম দিকে তারা একক যাত্রার কার্ড সরবরাহ করে ৩ লাখ ১৩ হাজার। এমআরটি কার্ড সরবরাহ করে ৭ লাখ ২৮ হাজারের মতো। এমআরটি কার্ডের প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আর নতুন করে কার্ড কিনতে পারেনি ডিএমটিসিএল। এ কারণে এমআরটি কার্ড নতুন করে বিক্রি করা বন্ধ রয়েছে। অল্প কিছু কার্ড রাখা হয়েছে, যেন কেউ হারিয়ে ফেললে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে নতুন কার্ড নিতে পারেন।
একক যাত্রার টিকিটের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল মঙ্গলবার ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে বলা হয়, যাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ও যাত্রীসংখ্যা বেশি—এমন স্টেশনে চাহিদামতো একক যাত্রার টিকিট পেতে বেশি সময় লাগছে। এদিকে যাত্রীরা ভ্রমণ শেষে নির্ধারিত স্থানে টিকিট রেখে না যাওয়ায় এবং কিছু কার্ডের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ায় টিকিটসংকট সৃষ্টি হয়েছে। সংকট সমাধানে দ্রুত একক যাত্রার কার্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিকল্প পদ্ধতি কিউআর কোড চালুর মাধ্যমে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ডিএমটিসিএল আশা করছে, চলতি মাসের শেষ নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, এখন তাদের হাতে একক যাত্রার টিকিট কার্ড আছে মাত্র ৩০ হাজারের মতো। এ মাসে আরও ৩০ হাজার কার্ড আসবে। জানুয়ারির শেষ দিকে আসতে পারে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো কার্ড। এরপরও একক যাত্রার টিকিট কার্ডের সমস্যা মিটবে না বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
চালু হচ্ছে কাগজের কার্ডও
একক যাত্রার কার্ডগুলোর প্রতিটি প্রায় দেড় শ টাকায় কেনা। এগুলো গ্রাহকেরা নিয়ে যাওয়ার ফলে একদিকে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে একটি কার্ড শত থেকে হাজারবার ব্যবহার করার সুযোগ নষ্ট হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, একক যাত্রার টিকিটগুলো নানাভাবে বেহাত হয়েছে, যেমন কেউ কেউ কার্ডটি স্যুভেনির হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছেন। এমনও ব্যক্তি আছেন, যিনি হয়তো মিরপুর থেকে মতিঝিল যাচ্ছেন, একসঙ্গে দুটি কার্ড নিয়েছেন; যাতে আসার পথে লাইনে না দাঁড়িয়ে সরাসরি ট্রেনে ওঠা যায়। আবার সাধারণত একই দূরত্বের ভাড়া পরিশোধ করে ফিরতি যাত্রার টিকিট কাটা যায়। একক যাত্রার কার্ড ভাড়া পরিশোধ করে নেওয়ার পর এর কার্যকারিতা ওই দিন রাত ১২টা পর্যন্ত থাকে। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে কেউ ফিরতি যাত্রায় কার্ড ব্যবহার না করে হয়তো বাসায় নিয়ে গেছেন আর ফেরত দেননি। শুরুর দিকে অনেকে একসঙ্গে একাধিক দিন চলাচলের জন্য একক যাত্রার টিকিট কিনেছিলেন। কিন্তু এক দিনের টিকিট অন্যদিন কার্যকর না হওয়ায় অনেকেই কার্ড আর ফেরত দেননি।
এ ছাড়া কিছু কার্ড ব্যবহারের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে একক যাত্রার কার্ড হাতে নিয়ে এস্কেলেটরের হাতলে ধরে ওপরে উঠে নষ্ট করেছেন। কোনো কোনোটা হাতে নিয়ে মোচড়ামুচড়ি করায় বেঁকে গেছে। কিছু কার্ডে কামড় বা আচড়ের চিহ্নও আছে।
এমন পরিস্থিতিতে একক যাত্রার কার্ডের সংকট কাটাতে নতুন কার্ড আমদানির পাশাপাশি বিকল্প উদ্যোগও নিয়েছে ডিএমটিসিএল। সংস্থার সূত্র জানিয়েছে, একক যাত্রার জন্য কাগজের কার্ড চালু করা হবে। এতে কিউআর কোড থাকবে। সেটি যন্ত্রে স্ক্যান করে প্রবেশ ও বের হতে পারবেন যাত্রীরা। এর জন্য প্রতিটি স্টেশনে একটা করে আলাদা যন্ত্র ও প্রবেশপথ চালু করা হবে। এসব কার্ড কেউ নিয়ে গেলেও সমস্যা নেই। বাইরের দেশে এ ধরনের টিকিটের প্রচলন আছে। চাইলে কেউ এক দিনের কাগজের টিকিট অন্য দিন ব্যবহার করতে পারবেন না।
কাগজের টিকিট সংগ্রহের লক্ষ্যে ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ডিএমটিসিএল। দেড় মাসের মধ্যেই একক যাত্রার কাগজের টিকিট চালু করার প্রচেষ্টা আছে। তবে একক যাত্রার প্লাস্টিক কার্ডও চলমান থাকবে। কারণ, মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে প্লাস্টিকের কার্ডের জন্য যন্ত্র বসানো আছে। এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকর এবং বেশিসংখ্যক যাত্রী ব্যবহার করতে পারেন।
এমআরটি নয়, র্যাপিড পাস
একটিমাত্র কার্ড ব্যবহার করে সব ধরনের গণপরিবহনে ভাড়া পরিশোধের সুবিধা চালু করতে ২০১৫ সালে প্রকল্প নেয় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ‘র্যাপিড পাস’ নামে পরিচিত এ কার্ডের মাধ্যমে রেল, সড়ক ও নৌপথে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া আদায় করতে পারবে। এ বিষয়ে ডিটিসিএর স্লোগান হলো, ‘ওয়ান কার্ড ফর অল ট্রান্সপোর্ট’।
২০১৫ সালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। বর্তমানে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ক্লিয়ারিং হাউস ফর ইন্টিগ্রেটিং ট্রান্সপোর্ট টিকিটিং সিস্টেম ইন ঢাকা সিটি অ্যান্ড অ্যাডজাসেন্ট ডিস্ট্রিক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। প্রকল্পটি সংক্ষেপে ‘ক্লিয়ারিং হাউস’ নামে পরিচিত। ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীন র্যাপিড পাস সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন অবশ্য জাইকা এ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তারা আর কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে না।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, শুরুতে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় একক যাত্রার ও স্থায়ী এমআরটি পাস সংগ্রহ করা হয়েছে। পরে এমআরটি পাস শেষ হয়ে যাওয়ায় তা পুনরায় কেনার উদ্যোগ নিলে ডিটিসিএ রাজি হয়নি। কারণ, ডিটিসিএ চায় মেট্রোরেলে পুরোপুরি র্যাপিড পাসে যেতে হবে। ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে ডিটিসিএ নিরাপত্তা কোড সরবরাহ করে। এমআরটি পাসের জন্য তারা আর কোড সরবরাহ করেনি। ফলে এমআরটি কার্ডও কেনা হয়নি।
ফলে এখন থেকে নতুন করে এমআরটি পাস বিক্রি করবে না মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। র্যাপিড পাসই সবাইকে নিতে হবে। মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোয় আগামী জানুয়ারি থেকে র্যাপিড পাসের সরবরাহ বাড়ানো হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, একক যাত্রার যাত্রীদের সমস্যা ডিসেম্বরের মধ্যেই কেটে যাবে। যাত্রীদের ভোগান্তি এড়াতে সব চেষ্টা চলছে। স্থায়ী পাস হিসেবে র্যাপিড পাসই বিক্রি করা হবে, এমআরটি পাস আর দেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি।