ঈদের নামাজ শেষে তিন বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন নাইমুর রহমান। কিছু দূর যাওয়ার পরই দুর্ঘটনায় কবলে পড়েন তিনি। এতে তাঁর বাঁ পায়ের হাড় তিন টুকরা হয়ে যায়। ঘটনার পর তাঁকে প্রথমে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের জরুরি বিভাগে কথা হয় নাইমুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল আরোহী তিনজনের মধ্যে তাঁর অবস্থা বেশি খারাপ। পায়ে হাড় ভাঙার পাশাপাশি মুখে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছেন। হঠাৎ একটি নছিমন সামনে আসার পর তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন বলে উল্লেখ করেন।
নাইমুর রহমান একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবা আমিরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে এসেছেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বাসিন্দা আমিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে নাইমুর বড়। দুর্ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হবে কি না, হলেও কত দিন লাগবে-এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
নাইমুরকে নিয়ে আসার আধা ঘণ্টা আগে মিরপুরের কালশী এলাকা থেকে শিমুল হোসেন নামের এক যুবককে আনা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে। দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে তিনি আহত হন। তবে অবস্থা খুব গুরুতর না হলেও তাঁর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে গেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন।
দুর্ঘটনা ঘটল কীভাবে-এমন প্রশ্নে শিমুল বলেন, একটি প্রাইভেট কার ও একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মাঝে পড়ে তাঁর এই দশা হয়েছে। তবে সঙ্গে থাকা দুই বন্ধুর কিছু হয়নি।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে অবস্থান করেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এ সময় অন্তত ছয়জনকে জরুরি বিভাগে এসে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। তাঁদের সবাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের আবাসিক চিকিৎসক তপন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অন্তত ১২০ জন রোগী এসেছেন, যাঁদের মধ্যে ৫০ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। আর ঈদের দিন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ২৫৬ জন। যাঁদের মধ্যে ৭৬ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। আহত ব্যক্তিদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তপন দেবনাথের সঙ্গে কথা বলে বের হওয়ার পর দেখা গেল এক কিশোর স্ট্রেচারে, তাকে ধরে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি কাঁদছেন। কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঈদের আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর ভাতিজার পা ভেঙেছে। এর খানিক পরেই ওই কিশোরের বাবা আবুল কাশেমও সেখানে আসেন। জানান তাঁর ছেলের নাম কাজী হামিম।
দুর্ঘটনা সম্পর্কে আবুল কাশেম বলেন, পরিবার নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের বাকলিয়া অ্যাকসেস রোড এলাকায় থাকেন। ঘটনার সময় তিনি হামিমকে নিয়ে অটোরিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন। পথে আরেকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে তাঁদের অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চালকের পাশে বসে থাকা হামিম বেশি আহত হয়, তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। প্রথমে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। হামিম যন্ত্রণায় ছটফট করছে উল্লেখ করে আবুল জানান, তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সে সবার বড়।
এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হচ্ছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা রাকিবুল ইসলামকে নিয়ে আসেন তাঁর স্বজনেরা। ঈদের দিন দুপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙেছেন তিনি। ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে ভর্তির পর শুক্রবার তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো।
ঈদে দুর্ঘটনার চিত্র এবার কেমন-এমন প্রশ্নে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, তাঁদের হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসেন। কেবল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কতজন হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়েছেন, এই তথ্য তিনি দিতে পারেননি।
অবশ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার অন্তত ৮০ জনকে শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের অবাধে চলাচল, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি এবং ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করে যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ ছাড়া উল্টো পথে যানবাহন চালানোকেও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করে সংগঠনটি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছরের ঈদুল আজহার সময় সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সংগঠনটির হিসাবে, সেবারের ঈদযাত্রার ১৫ দিনে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৩১২টি দুর্ঘটনায় ৩৪০ জন নিহত ও ৫৬৯ জন আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে ৯১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৪ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হয়েছিলেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ছিল।