বিআরটিএ গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করায় উদ্বেগ টিআইবির
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি বলেছে, বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে সত্যকে অস্বীকার করার এই দৃষ্টান্ত অনিয়ম-দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেবে। পাশাপাশি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘোষিত দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করবে।
আজ বৃহস্পতিবার টিআইবির এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে বিআরটিএর তোলা নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
পরদিন গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বিআরটিএ। তারা বলেছে, টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন অনুমাননির্ভর, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিআরটিএ গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো টিআইবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গবেষণাটি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন নয়, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের শূন্য সহনশীলতার দৃঢ় অঙ্গীকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে। একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনকে বিআরটিএর ‘বাস্তবতাবর্জিত, কাল্পনিক, অনুমাননির্ভর, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করায় কড়া সমালোচনা করেছে টিআইবি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিআরটিএর এমন মন্তব্য কাপুরুষোচিত আচরণ ও সমালোচনা সওয়ার মানসিকতার অভাবের পরিচায়ক।
মুখ্য তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ নিয়ে বিআরটিএর বক্তব্য প্রসঙ্গে টিআইবি দাবি করেছে, বিআরটিএ চেয়ারম্যান মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিআরটিএর চেয়ারম্যান অথবা তাঁর মনোনীত প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার নিতে টিআইবি থেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। গত ২৩ অক্টোবর বিআরটিএর চেয়ারম্যান সাক্ষাৎকার দিতে গবেষণা দলকে ডেকেও তিনি কার্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরে গত বছরের ১২ নভেম্বর চেয়ারম্যান সাক্ষাৎকারের জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেন। কিন্তু সাক্ষাৎকারে তিনি কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তাঁর পরিবর্তে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য মনোনীত করার অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে টিআইবির গবেষণা দল নিজস্ব সূত্রে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিআরটিএর কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেয়।
সেবা পেতে ঘুষ, দুর্নীতি বা হয়রানির শিকার ও সেবা পেতে ৩০ দিন সময় লাগার টিআইবির অভিযোগ অসত্য ও কল্পনাপ্রসূত বলে দাবি করেছে বিআরটিএ। এ প্রসঙ্গে টিআইবি বলেছে, গবেষণায় মোট ১৬৮ বাসমালিকের কাছ থেকে একটি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যানবাহন নিবন্ধনে সময়ক্ষেপণ ও অনিয়ম-দুর্নীতির যেসব তথ্য, সেসব বাসমালিকদের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে পাওয়া গেছে। এসব তথ্যকে অসত্য বা কল্পনাপ্রসূত বলার কোনো যুক্তি নেই।
ফিটনেস নবায়ন সেবা পেতে ঘুষ, দুর্নীতি বা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ সঠিক নয় ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছে বিআরটিএ। এর জবাবে টিআইবি বলেছে, জরিপে অংশ নেওয়া বাসমালিকেরা এক বছরে বাসের ফিটনেস সনদ ইস্যু বা নবায়নে বাসপ্রতি গড়ে ১৩ দিন সময় লেগেছে বলে জানিয়েছেন। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ফিটনেস সনদ ইস্যু বা নবায়নে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ বাসমালিককে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশ ও পরীক্ষা না করে ফিটনেসসহ অন্যান্য সনদ সংগ্রহের কথা বলেছেন জরিপে অংশ নেওয়া বাসমালিকেরা। বিআরটিএতে যা ঘটছে, তা জনস্বার্থে প্রকাশ করেছে টিআইবি।
প্রতিবেদনের রুট পারমিট ইস্যু বা নবায়নে সময়ক্ষেপণের বিষয়টি বিআরটিএ প্রত্যাখ্যান করেছে। জবাবে টিআইবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া বাসমালিকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট ইস্যু বা নবায়নে গড়ে ৪৫ দিন সময় লাগে। এ ছাড়া ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ বাসমালিক রুট পারমিট ইস্যু বা নবায়নে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার কথা বলেছেন। এখানে টিআইবির কোনো নিজস্ব সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা মন্তব্য উপস্থাপন করা হয়নি।
মোটরযান নিবন্ধন ও রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সনদ ইস্যু ও নবায়ন, রুট পারমিট ইস্যু ও নবায়নে ঘুষের বিষয়ে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়ে বিআরটিএ যা বলেছে, বিজ্ঞপ্তিতে তার জবাব দেওয়া হয়েছে।
টিআইবি বলেছে, গবেষণা জরিপে একটি প্রতিনিধিত্বশীল নমুনা নির্বাচন করে তিন ধরনের তথ্যদাতার কাছ থেকে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কাজেই গবেষণাটিকে অনুমাননির্ভর, উদ্দেশ্যমূলক বলে গণ্য করার সুযোগ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দুর্নীতির দায় এড়াতে সরকারকে জড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিআরটিএ। প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে বিআরটিএর ভাবমূর্তি যদি সত্যিই ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে, তবে তা প্রত্যাখ্যান না করে টিআইবির দেওয়া সুপারিশ অনুসরণ করে পদক্ষেপ নেওয়াই শ্রেয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, জরিপে বাসমালিক, কর্মী–শ্রমিক ও যাত্রীদের কাছ থেকে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে টিআইবি। দেশের ৬৪ জেলা থেকে ৩২টি জেলা প্রতিনিধিত্বশীল নমুনায়নের মাধ্যমে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ মানদণ্ড ও চর্চা অনুসারে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গবেষণায় থাকা সুপারিশকে গঠনমূলক ও বাস্তবধর্মী বলে স্বীকার করায় বিআরটিএকে ধন্যবাদ। টিআইবির সুপারিশ আমলে নিয়ে কাজ করার যে অঙ্গীকার করেছে বিআরটিএ, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।