গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা ফেরাতে হলে সত্য বলতে হবে

‘ফ্যাসিবাদের বয়ান বনাম গণমানুষের গণমাধ্যম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জুলাই গণপরিসর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে। ঢাকা, ২৬ অক্টোবর
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

গণমাধ্যম কেবল সরকার ও রাষ্ট্রের দাসত্ব করেনি। গণমাধ্যমের মূল সমস্যা অসত্য বলতে বলতে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আস্থা ফেরানোর পদ্ধতি একটাই—সত্য বলা। সাংবাদিকতা করতে পারলে, জবাবদিহির জায়গা তৈরি করা গেলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিজম আসবে না।

‘ফ্যাসিবাদের বয়ান বনাম গণমানুষের গণমাধ্যম’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ কথা উঠে আসে। আজ শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আলোচনার আয়োজন করে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান পর্যালোচনা প্ল্যাটফর্ম জুলাই গণপরিসর।  

দেশে গণমাধ্যমের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে উল্লেখ করেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর। সভায় তিনি বলেন, ‘কিন্তু এই মাধ্যম কেবল সরকার ও রাষ্ট্রের দাসত্ব করেছে, সেটা তো না। এই (আওয়ামী লীগ) সরকারের বিরুদ্ধে আপনাদের মুখস্থ করা যত অভিযোগ আছে, তার ৯০% আপনারা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে পেয়েছেন। যাঁরা আপনাদের জানিয়েছেন, তাঁরা অনেক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেছেন।’ সাংবাদিকদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং সমাজে গণতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন নূরুল কবীর।

সাংবাদিকতার ব্যর্থতাকে দেশে ফ্যাসিজম আসার মূল কারণগুলোর একটি বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো দিনও খুব যে ভালো সাংবাদিকতা করেছি, আমার মনে হয় না।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস অফিসের কাজ ছিল নজরদারি এজেন্সির ভূমিকা পালন করা—এমন মন্তব্য করে শফিকুল আলম বলেন, ওদের (প্রেস অফিস) কাজ ছিল সংবাদ কীভাবে নামানো যায়। সংবাদ হত্যার কাজ যে শুধু সরকার করেছে তা নয়, বেসরকারি খাতও ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় এই কাজ করেছে।

শফিকুল আলম বলেন, সংবাদে হস্তক্ষেপ করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস থেকে কাউকে ফোন দেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থাকেও এ ধরনের ফোন না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চায় দেশে সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিক হোক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক হোক। আরেকটা সরকার এলে আবার ফ্যাসিজম আসবে না, এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর মতে, ফ্যাসিজম নানাভাবে আসতে পারে। তবে সঠিক ইতিহাস লিখতে পারলে, সাংবাদিকতা করতে পারলে, জবাবদিহির জায়গা তৈরি করা গেলে মনে হয় না ভবিষ্যতে ফ্যাসিজম আসবে।

দেশের কোনো গণমাধ্যম যেন বন্ধ না হয়, সবাই থাকুক—এমন কথা বলেন শফিকুল আলম। তবে যেসব সাংবাদিক সঠিক সাংবাদিকতা করেননি, তাঁদের উচিত ‘সোল সার্চিং’ বা আত্মসমালোচনা করা বলে মনে করেন তিনি।

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ দালালি করা বলে মনে করেন দ্য ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা। তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা দালালির বিনিময়ে একটা সুবিধা পেয়েছেন। দালালির জায়গা বন্ধ করতে চাইলে ওই সময়ে যাঁরা দালালি করে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। হত্যা মামলা দিয়ে তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে না।

গণমাধ্যমের সমালোচনা হতে পারে এবং হওয়া দরকার। কিন্তু লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে যদি কোনো গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিতে বলা হয়, সেটা ফ্যাসিজম কি না, সেই প্রশ্ন রাখেন গোলাম মোর্তোজা। তিনি বলেন, দেশের গণমাধ্যমের মূল সমস্যা অসত্য বলতে বলতে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আস্থা ফেরানোর পদ্ধতি একটাই—সত্য বলা।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, দেশে আওয়ামী লীগের বয়ানের বাইরে গণমাধ্যম খুব একটা নেই। ফলে আওয়ামী লীগ না থাকলেও তাদের বয়ান হাজির হচ্ছে। তাই বিদ্যমান বয়ানের পাল্টা বয়ান নির্মাণ করা জরুরি।

প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট মোড (বয়ান) হচ্ছে দেশ একটা সংকটের মধ্যে আছে, উন্নয়ন বাধা দিচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে, জঙ্গিরা ঢুকে পড়ছে প্রভৃতি। আওয়ামী লীগের এই হুমকি, সংকটের মোড সব সময় একইভাবে গণমাধ্যম জারি রেখেছে।
সরকারের কর্মসূচির গুণগান গাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভির উপায় নেই বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই এই প্রতিষ্ঠানকে চলতে হবে। যেমন দেশ চলে তেমন করেই তার প্রতিষ্ঠান চলে।’

গত ১৫ বছর ধরে দেশের সাংবাদিকদের একটি অংশকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণের ইংরেজি বিভাগের প্রধান আয়েশা কবির।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্কৃতিকর্মী মোহাম্মদ রোমেল।