মানবতাবিরোধী অপরাধ
দল নিষিদ্ধের বিধান আসছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে
সংশোধনী প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে অল্প সময়ের মধ্যে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করার চিন্তা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। খুন, গুম, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কোনো দল বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে সেই দল বা সংগঠনের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল করা যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন সংশোধনী প্রস্তাবগুলো আরও যাচাই–বাছাই করছে বলে জানা গেছে।
তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব নিয়ে আইনজীবীদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, দেশে ভিন্ন একটি আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। এরপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে এ ব্যাপারে বিধান যুক্ত করা হলে, তা বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। তাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে সরকারি হিসাবে ৮৭৪ জন নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে গুমের অভিযোগগুলোর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে বিচার কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আইনটি সংশোধনের।
খুন, গুম, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কোনো দল বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে সেই দল বা সংগঠনের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল করা যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন সংশোধনী প্রস্তাবগুলো আরও যাচাই–বাছাই করছে বলে জানা গেছে।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে অল্প সময়ের মধ্যে তা অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হবে। যেহেতু দেশে এখন সংসদ নেই। এই অধ্যাদেশের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের শাসনের সময় ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচার করে তা কার্যকর করা হয়। একই অপরাধের অভিযোগে সংগঠন বা দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করার জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিধান রেখে এই আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা করেনি।
আওয়ামী লীগ তাদের শাসনের শেষ সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেই নিষিদ্ধাদেশ প্রত্যাহার করে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের কেউ কেউ। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, দেশের বিদ্যমান আইনেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে, তা উল্লেখ করে একটি স্বতন্ত্র আইন ‘দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮’ রয়েছে।
বিতর্ক কেন?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যেসব সংশোধনী আনা হচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিধান। এ বিষয়ে খসড়া সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনে যা–ই থাকুক না কেন, যদি কোনো সংগঠন এই আইনে খুন, গুম, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ করে, তাতে সাহায্য করে বা প্ররোচিত করে, তাহলে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সংগঠনের নিবন্ধন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত বা বাতিল করা যাবে। তবে নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলের সময় সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল চাইলে সংগঠনটিকে অন্য কোনো যথাযথ শাস্তিও দিতে পারবেন। সেই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের আপিল আবেদন করার বিধানও রাখা হচ্ছে এই সংশোধনীতে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের কেউ কেউ। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, দেশের বিদ্যমান আইনেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে, তা উল্লেখ করে একটি স্বতন্ত্র আইন ‘দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮’ রয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮–তে পরিষ্কার বলা আছে, কখন কীভাবে সরকার একটি রাজনৈতিক দলকে বাতিল করতে পারে বা নিষিদ্ধ করতে পারে। আইনটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই আইনজীবী উল্লেখ করেন, একটি দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য অপরাধের অভিযোগ বা কারণ জানিয়ে সরকার হাইকোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠাতে পারে। হাইকোর্ট উভয় পক্ষকে নিয়ে শুনানি করে তারপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাতিল বা অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আইনে বিষয়টিকে যুক্ত করা হলে, তা বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
অপরাধের সংজ্ঞায় বাড়ছে পরিধি
সংশোধনীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে খুন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, দাসত্ব, নির্মূল (কোনো একটি গোষ্ঠীকে), অবরুদ্ধ, নির্বাসিত, কারারুদ্ধ বা অন্য কোনো অমানবিক কাজকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এখন গুম, যৌনদাসী বানানো, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যত্বকরণের মতো বিষয়গুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাব আনা হচ্ছে।
আইনে উল্লেখ করা অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে কোনো কমান্ডার অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্দেশ বা অনুমোদন দিলে এবং ঘটনায় সরাসরি অংশ নিলে তাঁদের বিচার করার কথা বলা আছে। এখন কমান্ডার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকেও বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে গুম, যৌনদাসী বানানো, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ করানোর মতো বিভিন্ন বিষয়ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে সেই সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আওতায় বিচার করার জন্যই এর সংশোধন করা হচ্ছে। এটি মানতে রাজি নন সরকারি কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা ছিল। যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে সেই অস্পষ্টতা দূর হবে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেই অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে।
সীমানা বাড়ছে
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেই অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে। সেখানে অপরাধের সীমানা হিসেবে বাংলাদেশের জলসীমাকেও যুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি অন্য দেশে কোনো বাংলাদেশি মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে তাকেও এই আইনের আওতায় এনে বিচার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও জলসীমায় অন্য কোনো দেশের নাগরিক মানববতাবিরোধী অপরাধ করলে তাঁরও বিচার এই আইনে করার বিধান রাখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, যেহেতু এই আইনের আওতায় বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধকেও যুক্ত করা হচ্ছে, ফলে তা দেশি বা বিদেশি নাগরিক—যেই করুক দেশ আইনে তার বিচার করা যাবে। বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর (প্রধান কৌঁসুলি) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বিষয়ে আইনে অস্পষ্টতা ছিল, সেসব স্পষ্ট করা হচ্ছে। সেটি বিচারকাজকে গতিশীল করবে বলে তিনি মনে করেন।
গণ্য হবে অডিও–ভিডিও
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শুনানিতে ঘটনা সম্পর্কে অডিও–ভিডিও তথ্যকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে যেকোনো স্থানে তল্লাশি করে নথিপত্র জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি অনুমতি নিয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানি, তদন্তসহ অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ভুক্তভোগী বা তাঁর প্রতিনিধি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সাক্ষীর সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ও যুক্ত করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর (প্রধান কৌঁসুলি) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বিষয়ে আইনে অস্পষ্টতা ছিল, সেসব স্পষ্ট করা হচ্ছে। সেটি বিচারকাজকে গতিশীল করবে বলে তিনি মনে করেন।