গেল বছর শেখ হাসিনা ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি

বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

নির্বাচন, আন্দোলন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও দুর্যোগ মিলিয়ে ২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল। এ সময় ভুল ও অপতথ্যও বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে বেশির ভাগ ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। একক ব্যক্তি হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে জড়িয়ে।

তথ্য যাচাইকারী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার এ খবর জানিয়েছে। বুধবার প্রতিষ্ঠানটি ‘২০২৪ সালের ভুল তথ্যের পরিসংখ্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশের গণমাধ্যমে ছড়ানো ভুল তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ২ হাজার ৯১৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আগের বছর শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৯১৫টি ভুল তথ্য। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৫২ শতাংশ বেড়েছে ভুল তথ্য ছড়ানো।

সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের প্রচার দেখা গেছে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক তথা জুলাই-সেপ্টেম্বরে। এ সময়ে শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যের সংখ্যা ৮৪৭টি। আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ৩৮৬টি ভুল শনাক্ত করা হয়।

ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। গত বছর ফেসবুকে ২ হাজার ৩৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এরপরে রয়েছে ইউটিউব (৫৬৫টি), টিকটক (৫০৯টি) এবং এক্স বা সাবেক টুইটার (২০১টি)। গত বছর বাংলাদেশ নিয়ে এক্সে অপতথ্য ছড়ানো উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বলে জানায় রিউমর স্ক্যানার।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া গত বছর দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত প্রতিবেদনে ১৫১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেশি ভুল দুই সরকারপ্রধানকে জড়িয়ে

একক ব্যক্তি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছড়ানো সবচেয়ে বেশি, ২০৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়। এই তালিকায় পরের অবস্থানে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকে নিয়ে ছড়ানো ১১৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে ছড়ানো ৯৮টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই তিনজন শীর্ষে।

জাতীয় ক্ষেত্রে অবশ্য অধ্যাপক ইউনূসের পরে আছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে আসিফ নজরুলও রয়েছেন এ তালিকায়। ধর্মীয় দিক থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে জড়িয়ে ছড়ানো ভুল তথ্য সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে।

রাজনৈতিক অপতথ্য বেশি

গত বছর রাজনীতি নিয়ে ৭২৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছড়ানো ৯১টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ১২৪টি রাজনৈতিক ভুল তথ্য শনাক্ত হয় জানুয়ারি মাসে। এরপর আগস্ট ও নভেম্বরে ১০১টি করে রাজনৈতিক ভুল তথ্য শনাক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি।

গত বছর আওয়ামী লীগ এবং দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাদের জড়িয়ে মোট ৫১০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে। ভুল তথ্যের মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা ভারত থেকে লাইভ করছেন, তাঁর দেশে ফিরে আসার দৃশ্য দাবি করা ভিডিও, তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন ও ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিকে জড়িয়ে ১৩০টি, জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে ৮২টি, জাতীয় পার্টিকে জড়িয়ে ১৮টি এবং গণ অধিকার পরিষদকে জড়িয়ে ছড়ানো ৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই দলের প্রধানকে জড়িয়ে ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। তাদের জড়িয়ে ছড়ানো ২৪টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এ ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মের নেতাদের নিয়ে ৮৩টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারকে জড়িয়ে ছড়ানো ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

আরও পড়ুন

সাম্প্রদায়িক অপতথ্য বেশি ছড়িয়েছে ভারত থেকে

রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আগস্ট থেকে ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে সাম্প্রদায়িক ২৯টি অপতথ্য শনাক্ত হয়। পরের ছয় মাসে তা পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারবিহীন তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাসা ও স্থাপনায়ও হামলা হয়। এসব ঘটনা ঘিরে সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে এক্স।

রিউমর স্ক্যানার এক্সে ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করে, যেখানে বাংলাদেশের সম্পর্কিত অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচার হয়। ভুয়া ও অপতথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন। অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে দায়িত্বশীল অনেক ব্যক্তিও রয়েছেন। এমনকি ভারতের একাধিক মূলধারার গণমাধ্যমও এসব ভুয়া তথ্য প্রচার করেছে।

আরও পড়ুন

গত বছর বাংলাদেশকে নিয়ে ১৮১টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত হয়, যার মধ্যে ১১৮টি ভারত থেকে আর ৬৩টি বাংলাদেশ থেকে ছড়ানো হয়। শুধু আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত থেকে ১১৩টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়ানো হয়। এক্সে আগস্ট–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে ছড়ানো অপতথ্যগুলো দেখা হয়েছে অন্তত ২০ কোটি বার।

রিউমর স্ক্যানার বলেছে, গত বছর ১২টি ডিপফেক ভিডিও এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে তৈরি ১০৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম, পুরোনো ফুটেজ ব্যবহার করে এবং নকল ফটোকার্ড তৈরি করে ছড়ানো ৫০৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

আরও পড়ুন