‘মানবদেহে কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে সিএমএল বা ব্লাড ক্যানসার হয়। বাংলাদেশে মোট ক্যানসার রোগীদের মধ্যে সাড়ে ছয় শতাংশই সিএমএল বা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশের প্রায় আড়াই লাখ নতুন ক্যানসার রোগীর মধ্যে অর্ধেকের বেশিই সিএমএলে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে অন্যান্য ক্যানসারের মতো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে সিএমএলে বেঁচে থাকার হার ৮০ শতাংশ।’ অনুষ্ঠানের শুরুতেই এ তথ্য জানান উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন।
২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব সিএমএল দিবস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলোজির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। অতিথি হিসেবে ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সিএমএল বা ব্লাড ক্যানসারের প্রভাব, সচেতনতা এবং এর নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এটি গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
আলোচনার শুরুতেই ব্লাড ক্যানসার সম্পর্কে ধারণা দেন ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা। তিনি বলেন, ‘সাধারণত মানবদেহে প্রতিনিয়ত কোষ সৃষ্টি হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর মরে যায়। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারে মানবদেহে অস্বাভাবিকভাবে কোষ বৃদ্ধি পায়, যা ধ্বংসও হয় না। ফলে তা রক্তকে নষ্ট করে দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের দেহে কোষের সংখ্যা ৪ হাজার থেকে ১১ হাজার। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারের রোগীর দেহে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে সেটির পরিমাণ লাখের বেশি হয়ে থাকে। অপ্রয়োজনীয় এ ধরনের কোষের প্রভাবে প্রয়োজনীয় কোষগুলোও কাজ করতে পারে না।’
ব্লাড ক্যানসারের জন্য কি জেনেটিক মিউটেশন বা বংশগত ব্যাপার দায়ী? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা জানান, এর জন্য বংশগত একটা ব্যাপার রয়েছে। সাধারণত দেহে কোষগুলো সিগন্যাল দেয়। সেখানে কোনো কোষ যদি অ্যাবনরমাল সিগন্যাল দেয়, সেটাকে ব্লাড ক্যানসার বলে। মানব শরীরে থাকা ২৩ জোড়া ক্রোমোজমের মধ্যে ৯ নম্বর ও ২২ নম্বর ক্রোমোজোম রেট হয়ে একটা আরেকটার সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ফলে সেল পলিপাসের নরমাল সিগন্যালটা এখান থেকেই হয়। কিন্তু এটা যখন অ্যাকসেস পলিপেশন হয়, তখনই ক্যানসার হয়। এখান থেকে একটা জিন প্রোডাক্ট তৈরি হয়, যার নাম ‘বিসিআরএবিএন ওয়ার্ড’। এ জিন প্রোডাক্টটাই মূলত সিগন্যাল হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে ব্লাড ক্যানসারের প্রভাবগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘আমাদের দেশে সঠিকভাবে পরিসংখ্যান রাখা হয় না বলে আমরা বৈশ্বিক পরিসংখ্যান অনুসরণ করি। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়া বা সিএলএলের সংখ্যা বেশি। যেখানে বাংলাদেশে ক্রনিক মাইলয়েড লিউকোমিয়া বা সিএমএলই বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে প্রচলিত ক্যানসারগুলোর মধ্যে ব্লাড ক্যানসারের স্থান চতুর্থ।’
ব্লাড ক্যানসারের উপসর্গগুলো কী? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘সাধারণত এটি দীর্ঘমেয়াদি হয়। অর্থাৎ ক্রোমোজোম পরিবর্তন হওয়ার পর সিএমএল রোগের উপসর্গে আসতে আট বছরের মতো সময় লাগে। উন্নত দেশে সব সময় চেকআপ করার কারণে তারা আগেই লক্ষণগুলো বুঝতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না। তাই শনাক্ত করতেও দেরি হয়ে যায়। ফলে পেটের ভেতরের স্প্লিন বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, গায়ে তীব্র ব্যথা করা, ছোট ছোট গুটি ওঠা, কাজে ও খাওয়ায় অরুচি, অল্পতে হাঁপিয়ে যাওয়া, রক্তনালি বন্ধ হওয়া ইত্যাদি ব্লাড ক্যানসারের উপসর্গ।’
এরপর উপস্থাপক জানতে চান, ব্লাড ক্যানসারের সম্পূর্ণ চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব কি না?
ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘বাংলাদেশেই সিএমএল বা ব্লাড ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা রয়েছে। তাই এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে রোগীকে প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি এবং অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট হলো এসকেএফ অনকোলোজি। এ ছাড়া সারা দেশে তাদের রয়েছে ৩৩টি সেবা কেন্দ্র, যার মাধ্যমে এই ওষুধগুলো পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।
সিএমএল রোগীদের খাদ্যাভ্যাসে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি কি না? এ প্রসঙ্গে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘শুধু সিএমএল নয়, সব ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, ফুডটা একটা ফ্যাক্টর। কারণ, খাদ্যে যে কেমিক্যাল মেশানো হয়, সেগুলো জিনকে ধ্বংস বা বৃদ্ধি করছে, যেটাকে আমরা “জিন মিউটেশন” বলছি। সুতরাং এ ধরনের রোগীদের বাইরের খাবার খাওয়া উচিত নয়। গ্রিন ফুড এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। একই সঙ্গে কেমিক্যালযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।’
ব্লাড ক্যানসারে কি বয়স্করাই বেশি আক্রান্ত হন? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা জানান, সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই ব্লাড ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হন। কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার খুব কম, যাকে বলা হয় ‘চাইল্ডহুড বা জুবেনাল সিএমএল’। এর কারণ হলো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের রেডিয়েশন ও পরিবেশের পরিবর্তন। তাই নির্দিষ্ট সময় পরপর চেকআপ করলে প্রাথমিক অবস্থায়ই এ রোগ মোকাবিলা করা যায়।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসায় কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে কি না, জানতে চাইলে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘অবশ্যই আছে। ব্লাড ক্যানসারের রোগীর চিকিৎসার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। এর অভাবে সঠিক সময়ে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসতে হবে।’
ব্লাড ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘কোনো ব্লাড ক্যানসারের রোগী অন্য সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য গেলে ভয়ে অনেকেই চিকিৎসা দিতে চান না। গ্রামাঞ্চলে এটাকে ছোঁয়াচে রোগ বলা হয়। কিন্তু এ ধারণা ভুল। সঠিক চিকিৎসায় ব্লাড ক্যানসারের রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ হয়। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো, যাতে কেউ কুসংস্কারের কারণে হেনস্তার শিকার না হন।’
সিএমএল বা ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (বিএমটি) কতটা জরুরি? এ প্রসঙ্গে ডা. এম. মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, ‘সাধারণত সিএমএলের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োজন হয় না। ক্যানসার যদি লাস্ট স্টেজে চলে যায় এবং কেমোথেরাপিতেও কাজ না করে, তখন বিএমটির প্রয়োজন হতে পারে। আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশেই এখন বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে।’