নিষ্ঠাবান গবেষকের সঙ্গে গোলাম মুরশিদের ছিল এক সত্য জীবনযাপন। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াননি তিনি। নিজের মৌলিক রচনা দিয়ে গোলাম মুরশিদ বাংলা ভাষার গবেষণাকে নিয়ে গিয়েছেন অনেক দূরে। তাই তাঁর কাজ নিয়ে চর্চাই হবে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গতকাল শনিবার প্রয়াত গবেষক গোলাম মুরশিদ স্মরণসভায় উঠে আসে এসব কথা। বিকেল পাঁচটা থেকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে শুরু হয় এ স্মরণ আয়োজন। বাংলাদেশ, ভারত, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এতে অংশ নিয়েছেন শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সাংবাদিক ও গোলাম মুরশিদের পরিবারের সদস্যরা।
অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা বলেন, গোলাম মুরশিদ শুধু সহকর্মী নন, ছিলেন সহমর্মীও। গোলাম মুরশিদের আশার ছলনে ভুলি, বিদ্রোহী রণক্লান্ত বই দুটির প্রসঙ্গ টেনে সনৎ কুমার সাহা বলেন, অক্লান্ত পরিশ্রমী গোলাম মুরশিদের কাজ সাহিত্যে আগ্রহীদের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে থাকবে। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময় একসঙ্গে নৌকায় করে পদ্মা নদী অতিক্রমের কথা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বইটিতে ইতিহাস থেকে শুরু করে সংস্কৃতি সব আছে। ‘বাংলাদেশি’ শব্দটির উদ্ভব নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করে গোলাম মুরশিদ অসম সাহস দেখিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গোলাম মুরশিদের স্ত্রী এলিজা মোরশেদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তিনি ৫৫ বছরের দাম্পত্যজীবনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘কাজই ছিল গোলাম মুরশিদের অবসরের জায়গা। সব সময়ই সে কাজের তাড়ায় থাকত। মৃত্যুর আগেও সে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বইয়ের পুনর্মূল্যায়ন করেছে।’ এলিজা মুরশিদ বলেন, ‘দেশের মানুষ যে তাকে এত ভালোবাসে, তা সে বেঁচে থাকতে বুঝতে পারিনি।’ বাবার উদ্দেশে কবিতা পাঠ করেন গোলাম মুরশিদের মেয়ে অমিতা।
গোলাম মুরশিদের ছোট বোন লিলি বলেন, ‘বড় ভাই হিসেবে তিনি সব সময় সত্য আর ভালো কিছুর সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।’
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, গোলাম মুরশিদের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিল বিদ্যার বিনয়ে। বহু বিদগ্ধজনও কখনো কখনো তাঁকে কুৎসিতভাবে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু নিজের সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হননি গোলাম মুরশিদ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে রেকর্ড পাঠিয়ে গোলাম মুরশিদকে স্মরণ করেছেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, একসময় বাঙালির ভাবনাচিন্তার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। কিন্তু দুই বাংলা ভাগ হওয়ার পর বাংলার একটি স্বতন্ত্র পরম্পরা তৈরি হয়েছিল। সেই পরম্পরার এক উজ্জ্বল সদস্য ছিলেন গোলাম মুরশিদ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের ছাত্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল। তিনি বলেন, গোলাম মুরশিদ প্রথমেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বন্ধনটি তৈরি করে নিতেন। মানুষের জীবনের আগ্রহ ও বৈচিত্র্য জানার সম্পর্কে তাঁর যে আগ্রহ ছিল, তা বিস্ময়কর। এ সময় তিনি ৫৫ বছর আগের স্মৃতিচারণা করে বলেন, গোলাম মুরশিদ নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র করেছিলেন পাকুড়গাছের পাতায়।
অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার বলেন, আজীবন লেখায় ভাবনায় দৃষ্টিভঙ্গিতে, যাপনে আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন গোলাম মুরশিদ। এ সময় বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলেন স্বরোচিষ সরকার। এক বছরের মধ্যে একটি স্মরণ সংখ্যা প্রকাশের কথা জানান স্বরোচিষ সরকার। অধ্যাপক সফি আহমেদ লন্ডনে গোলাম মুরশিদের বসবাসের ঘরে বসে স্মৃতিচারণা করেন। বিদ্যার প্রতি, জ্ঞানের অনুশীলনের প্রতি তাঁর একাত্মতা এক উদাহরণ নিয়ে কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানের অন্যতম একজন আয়োজক ছিলেন বিধান চন্দ্র পাল। তিনি বলেন, দেশে যদি গুণীজনের কদর করা হতো, তাহলে গোলাম মুরশিদ আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতেন। তাঁর কাজের মধ্যেই সেই উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে। কলমের যে শক্তি থাকে, সেই সত্যকে প্রমাণ করে গিয়েছেন গোলাম মুরশিদ।
স্মরণানুষ্ঠান শুরু হয় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী লাইসা আহমদ লিসার কণ্ঠে গান দিয়ে। এ ছাড়া এই আয়োজনে আরও সংযুক্ত ছিলেন অরুণ কান্তি চট্টোপাধ্যায়, মাশরুর শাকিল, ডক্টর মাহমুদুল করিম, স্থপতি সালমা সফি, শর্মিষ্ঠা দাস গুপ্ত, ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান মারুফ, শুভ্রনীল ভট্টাচার্যসহ আরও অনেকে।