একই কাজে আইসিটির দুই সংস্থা, ২৪ কোটি টাকার ল্যাবে তদন্ত কম
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সংস্থা কন্ট্রোলার অব সার্টিফায়িং অথরিটি (সিসিএ) এক দশকের পুরোনো। ডিজিটাল স্বাক্ষর সনদ প্রদানের পাশাপাশি সাইবার অপরাধ দমন, শনাক্ত, তদন্তসংক্রান্ত নানা দায়িত্ব ছিল এই সংস্থার। তবে সিসিএ এখন পর্যন্ত মূলত এই সনদই দিয়ে যাচ্ছে। আর এত বছরে এই সনদের সংখ্যা ৬০ হাজারের কম। ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসিএর ফরেনসিক ল্যাবে তদন্ত হয় খুব কম।
আইসিটি বিভাগের আরেক সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) সাইবার অপরাধ দমন, শনাক্ত, তদন্তসংক্রান্ত কাজ করছে। সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের দুই সংস্থার একই ধরনের কাজ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিসিএ নামের একটি সংস্থা রয়েছে। তারা শুধু ডিজিটাল স্বাক্ষর সার্টিফিকেট–সংক্রান্ত কাজই করে। সেই মডেল অনুসরণে বাংলাদেশ সরকার ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর প্রবর্তনের লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে ৩ বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। ২০১১ সালের মে মাসে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে সিসিএ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিসিএ কী করছে
সিসিএর কর্মপরিধির মধ্যে আছে ডিজিটাল স্বাক্ষর সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স প্রদান ও তাদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করা। এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য, গ্রাহকের তথ্যের সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থাপনা, সাইবার অপরাধে মামলার তদন্ত করাও সিসিএর কাজ। এ ছাড়া ডিজিটাল স্বাক্ষরের বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয় তারা।
সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে বলা আছে, আইসিটি আইনের অধীনে কোনো অপরাধ হলে বা হচ্ছে মর্মে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ থাকলে তল্লাশি করা, বস্তু আটক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা অপরাধীকে তারা গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ছাড়া ডিজিটাল স্বাক্ষরের বিষয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয় তারা।
সিসিএ এখন পর্যন্ত সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য লাইসেন্স দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ৫৬ হাজার ২০১টি ডিজিটাল স্বাক্ষর সার্টিফিকেট বিতরণ করেছে। তাদের জনবলের সংখ্যা ৩২।
ডিজিটাল স্বাক্ষর ছাড়াও সাইবার সচেতনতা গড়ে তোলা, বিশেষ করে মেয়েদের এ বিষয়ে কন্যাকথা নামের এক প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিসিএ। এই কর্মসূচির আওতায় ৮৯ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।
সিসিএ ও বিসিসি একই কাজ করছে
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ চালু হওয়ার আগে সিসিএর অধীনে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০১৫’ নামে একটি আইনের খসড়াও হয়েছিল। সেখানেই বলা ছিল, সিসিএ ‘সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট’ হিসেবে সাইবার অপরাধ শনাক্ত, দমন, তদন্তসহ সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে।
কিন্তু পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি নামে ভিন্ন একটি সংস্থা গঠিত হয়। এ ছাড়া সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অধীনে বিজিডি ই-গভ সার্ট নামে একটি প্রকল্প শুরু করা হয়।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা আছে, তারা ২০ জন জনবল নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা সেল গঠন করেছে। এ ছাড়া তাদের মিশনে সাইবার অপরাধ দূরীকরণে জাতীয় ও আঞ্চলিক যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে।
সিসিএ কার্যালয়ে মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন ও নিরাপত্তা বিধান নামে একটি প্রকল্প চালু আছে সংস্থাটির। সার্টিফায়িং অথরিটিকে সম্পৃক্ত করে সাইবার ইনসিডেন্ট–সংক্রান্ত তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, উচ্চ দক্ষতার সাইবার টেকনিক্যাল টিম গঠন, সম্ভাব্য সাইবার আক্রমণ থামানো, ঝুঁকি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা, সিসিএর আওতাধীন সিস্টেমসহ জনগণকে সাইবার আক্রমণ বিষয়ে সচেতন করে তোলা হবে এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের সময়কাল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত। আগে ছিল ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত। সরকারি অর্থায়নে এর ব্যয় ৫৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের যেসব উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, সেই একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে বিজিডি ই-গভ সার্ট।
অনলাইন শিষ্টাচার, সাইবার সুরক্ষা, নিরাপত্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার নামে একটি কর্মসূচি চালু করে আইসিটি বিভাগ। কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি প্রকল্পের অধীনে এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেখানেও স্কুলশিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সীদের জন্য সাইবার সচেতনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখানো হয়। অর্থাৎ অভিন্ন বিষয়ে দুটি ভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম চলছে।
২৪ কোটি টাকার ল্যাবে কাজ কতটুকু
সিসিএর অধীনে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ২৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব চালু হয়। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ৪ বছরে এ ল্যাব থেকে ১৫টি মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫২টি ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১টি মামলার তদন্ত করে তারা, অর্থাৎ গত ২ বছরে তারা মাত্র ৪টি মামলার জন্য ফরেনসিক পরীক্ষা করতে পেরেছে।
সিসিএর সংশ্লিষ্ট এক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সংস্থাটির অনেক কিছুই করার কথা ছিল। এমনকি আইসিটি আইনটি সিসিএকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু প্রশাসন যেখানে যা চাইবে, তা সেখানেই হবে। মামলার তদন্তের জন্য ফরেনসিক ল্যাব করা হয়। তদন্তের জন্য লোকবলও আছে। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ ধরনের ল্যাব করে। ফলে মামলার ভার তাদের কাছেই চলে যায়।
আইসিটি বিভাগেরই কম্পিউটার কাউন্সিলের অধীনে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে আরেকটি ফরেনসিক ল্যাব উদ্বোধন করা হয়। সেখানেও সাইবার অপরাধসংক্রান্ত মামলার তদন্তের প্রয়োজনে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। যেখানে ৪ বছরে ৪৪টি মামলার তদন্ত হয়েছে এবং মোট আলামতের সংখ্যা চার শতাধিক। সরকারের একই বিভাগের অধীনে একই কাজের জন্য দুটি ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ফরেনসিক ল্যাবে মামলা কম আসার বিষয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, এটা আদালতের সিদ্ধান্ত। আদালত যাকে মনে করবেন, তার কাছেই দায়িত্ব দেবেন। বিসিসির অধীনে থাকা ল্যাবটি প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানে সরকারের প্রয়োজনে বিভিন্ন ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষাগুলো করা হয়। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আইসিটি আইন, ২০০৬–এর অধীনে সরকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং একই আইনের অধীনে সিসিএ সাইবার অপরাধ তদন্ত করে। সে হিসেবে সিসিএর ল্যাবের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি ফরেনসিক ল্যাব থাকা প্রসঙ্গে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ২০১৮ সালে আইসিটি বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকেই যেন এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়।