মংডুতে মর্টারশেল-বোমার সঙ্গে ড্রোন হামলা, এপারে আতঙ্ক

টেকনাফ নফ নদীর বাংলাদেশ জলসীমানায় কোস্টগার্ডের টহলছবি: প্রথম আলো

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপে থেমে নেই মর্টারশেল-বোমার বিস্ফোরণ। এর মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে ড্রোন হামলা। তাতে হতাহতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। কিছু রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশের টেকনাফ পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে নাফ নদীর বাংলাদেশ জলসীমায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড তৎপর থাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে রাখাইনে সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার সীমান্তবর্তী মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশটির রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত চলছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ)। এর মধ্যে গত দুই সপ্তাহ ধরে মংডু টাউন ও আশপাশের চারটি গ্রাম মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, নুরুল্লা ও হাস্যুরাতা এলাকায় উভয় পক্ষের সংঘাত চলছে।

চারটি গ্রামসহ মংডু টাউনে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। টেকনাফ সদর ও পাশের সাবরাং ইউনিয়নের বিপরীতে মংডু টাউনশিপ। মাঝখানে চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদ দুই দেশকে বিভক্ত করে রেখেছে।

১০ আগস্ট আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সোমবার মিয়ানমারের উপকূলীয় শহর মংডুর ঠিক বাইরে অবস্থিত এলাকায় এক ড্রোন হামলায় ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। পরিবারের সবাই মারা গেছেন এমন একাধিক পরিবারও রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানে কাদামাটির ওপর লাশের স্তূপ পড়ে আছে। হতাহত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তে অবস্থান করছিলেন। এ হামলার জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনী একে অপরকে দায়ী করছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, মংডু উপকূল থেকে বহু রোহিঙ্গা ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ পালানোর চেষ্টা করছে। নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রমকালে একাধিক নৌকা ডুবির ঘটনাও ঘটেছে। গত সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ জলসীমানা থেকে অন্তত ৪৪ জন রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন নারী, ১৮টি শিশু ও ৭ জন পুরুষ।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে আজ রোববার বেলা দুইটা পর্যন্ত মংডু টাউনশিপ ও আশপাশে গ্রামে থেমে থেমে বিস্ফোরণ ঘটছে। নাফনদীর এপারে টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং ও হ্নীলা ইউনিয়নের মানুষ বিকট শব্দের ওই বিস্ফোরণ শুনতে পান। দিনের বেলায় এপারের বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সীমান্তের ওপারে (মংডুতে) মাঝে মধ্যে বিমান হামলা প্রত্যক্ষ করা যায়। হ্নীলা ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার জেলে আবদুল করিম বলেন, টানা পাঁচ মাসের বেশি ধরে এপারের মানুষ ওপারের মর্টার শেল বিস্ফোরণ নিয়ে আতঙ্কে আছেন। নাফ নদীতে মাছ শিকারও বন্ধ আছে। এখন সেখানে ড্রোন হামলা হওয়ায় এপারের মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।

গত দুই সপ্তাহ ধরে মংডুতে দুই পক্ষের সংঘাত তীব্র হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, বিমান হামলার পাশাপাশি এখন সেখানে ড্রোন হামলাও হচ্ছে। মর্টারশেল ও ভারী গোলার বিস্ফোরণে এপারে টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, কায়ুকখালীয়পাড়া, পল্লানপাড়া, কুলালপাড়াসহ আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২৩টি গ্রামে ভূকম্পন দেখা দিচ্ছে। মংডু থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা টেকনাফে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন। নাফনদীর বাংলাদেশ জলসীমানা থেকে বহু রোহিঙ্গাকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, গোলাগুলি সংঘাতের মধ্যেও  মংডু থেকে দেশটির সীমান্তরক্ষী বিজিপি ও রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি-কোস্টগার্ড তাঁদের ঢুকতে দিচ্ছে না। সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ উপকূলে রোহিঙ্গাদের লাশ ভেসে আসছে। নাফ নদীতে আরও লাশ ভাসছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সীমান্তে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে টেকনাফ বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন মংডু থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ১১০ জন বিজিপি ও সেনা সদস্য। এ ছাড়া আশ্রয় নেওয়া একজন অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। ওপারের বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির ঘটনায় আতঙ্কে থাকা এপারের লোকজনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নাফ নদী ও সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারের কেউ যেন বাংলাদেশ ঢুকতে না পারেন সে ব্যাপারে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।