মায়েরা জানেন না কীভাবে স্যালাইন তৈরি করতে হয়, শিশুকে খাওয়াতে হয়
স্যালাইনের প্যাকেটে কী লেখা আছে, দেশের মায়েদের বড় অংশ তা পড়তে পারেন না। পড়তে পারলেও অনেকে পড়ে দেখেন না। অনেকে সঠিকভাবে স্যালাইন তৈরি করতে এবং শিশুকে খাওয়াতে জানেন না।
ভুল নিয়মে তৈরি করা এবং ভুলভাবে খাওয়ানো স্যালাইন যে শিশুর ক্ষতি করে, তা দেশের অনেক মা জানেন না।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সদ্য পরিচালিত এক গবেষণা এমনটাই বলছে। আইসিডিডিআরবির মহাখালী হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অতিসম্প্রতি ভর্তি হওয়া পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মায়েদের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। জরিপ করে ৩৫০ জন মায়ের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়। পাশাপাশি ৩১ জন মায়ের ইন-ডেপথ ইন্টারভিউ বা বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড, সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি অথবা সরকার-অনুমোদিত যে কোনো ওষুধ কোম্পানির তৈরি ওআরএসের (ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস) প্যাকেটে স্যালাইন তৈরি, খাওয়ানো ও সংরক্ষণের বিষয়ে নির্দেশনা ছাপানো থাকে।
নির্দেশনা অনুযায়ী, ওআরএসের প্যাকেটের সম্পূর্ণ উপকরণ আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে ভালোভাবে গুলিয়ে নিতে হবে। শিশুর বয়স অনুসারে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টায় এই পরিমাণ স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
নবজাতককে (২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী) ১২ ঘণ্টায় আধা লিটার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।বয়স্করা প্রয়োজনমতো খাবেন। গরম পানি দিয়ে দ্রবণ তৈরি করা যাবে না বা দ্রবণ ফুটানো যাবে না। এ দ্রবণ ১২ ঘণ্টা পর ফেলে দিতে হবে।
বহু বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডায়রিয়া চিকিৎসায় ওআরএসের উপকরণের (সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম সাইট্রেট ও এহাইড্রোজ গ্লুকোজ) পরিমাণ নির্ধারণ এবং দ্রবণ তৈরির উপায় ঠিক করেছেন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশে ওআরএসের ব্যবহার বেড়েছে কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা উদ্বেগের বিষয়।উদ্বেগ এই কারণে যে, শিশুদের রক্তে হঠাৎ লবণের পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটা তাদের বড় ক্ষতি করে—খিঁচুনি দেখা দেয়, কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়।আর রক্তে লম্বা সময় ধরে লবণ বেশি থাকলে শিশুর মৃত্যু হতে পারে, বেঁচে থাকলে তার প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি থাকে। রক্তে লবণ বেশি থাকার লক্ষণকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’ বলা হয়।
খাবার স্যালাইন শিশুর শরীরে বাড়তি লবণ বা সোডিয়াম আসার বড় কারণ হতে পারে। জরিপভুক্ত অনেক মা আধা লিটার পানির পরিবর্তে কম পানি দিয়ে স্যালাইন তৈরি করেন। দ্রবণটি তখন গাঢ় হয়। গাঢ় দ্রবণে লবণ বেশি থাকে।আবার কোনো কোনো মা দ্রবণ ঠিকভাবে তৈরি করলেও শিশুকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি স্যালাইন খাওয়ান। কেউ আবার তৈরি করার পর ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়া স্যালাইন খাওয়ান।
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে
আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, জরিপভুক্ত ৮৮ শতাংশ মা ওআরএস সম্পর্কে সঠিক জানেন না। ৭২ শতাংশ মা ডায়রিয়া-আক্রান্ত শিশুকে যেভাবে খাওয়ার স্যালাইন দেন, সে পদ্ধতিটি সঠিক নয়।
ডায়রিয়ার মূল চিকিৎসা যে খাওয়ার স্যালাইন, জরিপভুক্ত ৬৮ শতাংশ মা তা জানেন। তবে প্রায় ২৪ শতাংশ মায়েদের ধারণা, ডায়ারিয়ার চিকিৎসায় স্যালাইনের চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক বেশি উপকারী।অন্যদিকে জরিপভুক্ত প্রায় সব মা (৯৭ শতাংশ) মনে করেন, তাঁরা ওআরএস তৈরির নিয়ম জানেন। তবে এই মায়েদেরও কেবল ৬৫ শতাংশ তৈরির যথাযথ ধাপগুলো অনুসরণ করেন। স্যালাইনের প্যাকেটে লেখা নির্দেশনা ও তথ্য মাত্র ২৩ শতাংশ মা পড়ে থাকেন।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে (৩১ জনের) অধিকাংশ মা গবেষকদের জানিয়েছেন, তাঁরা সাধারণত পুরো প্যাকেটের স্যালাইন-গুঁড়ো একসঙ্গে ব্যবহার করেন না। অনেক ক্ষেত্রেই প্যাকেটের গায়ে থাকা নির্দেশনা মেনে নিরাপদ পানি নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করেন না।
গবেষণায় মায়েদের একটি ভুল ধারণার কথা উঠে এসেছে, যা স্যালাইনের ভুল ব্যবহারের জন্য দায়ী হতে পারে। অধিকাংশ মায়ের ধারণা, শিশু যদি মায়ের বুকের দুধ খায়, তাহলে মা স্যালাইন খেলে দুধের সঙ্গে সেটা শিশুর দেহেও পৌঁছায়। এই ভুল ধারণাটি মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই শীতে অনেক শিশু রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া নিয়ে আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তাদের অনেককে আইসিইউতে রাখতে হচ্ছে। কারণ, বাড়িতে তাদের হয় ভুলভাবে তৈরি করা স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছে, অথবা বিধি না মেনে খাওয়ানো হয়েছে।