বসনিয়া থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশী অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরানোর তাগিদ দিয়ে চিঠি
পশ্চিম বলকান অঞ্চলের দেশ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার জঙ্গল দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপযাত্রার খবর কয়েক বছর ধরে সামনে আসছে। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে দেশটির জঙ্গলে বাংলাদেশিদের আটকে পড়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ফলে বসনিয়ায় আটকে পড়া অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীর তালিকায় বাংলাদেশের নামও উঠে এসেছে। বিষয়টি বসনিয়াকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তাই তারা এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর অনুরোধ করেছে।
বসনিয়ায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) অভ্যর্থনাকেন্দ্রে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজারের মতো অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী অবস্থান করছেন। অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচার প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি সূত্র চলতি সপ্তাহে বসনিয়া থেকে প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের বিষয়টি সুরাহার জন্য গত মাসের শেষ দিকে বসনিয়ার নিরাপত্তামন্ত্রী সেলমো সিকোটিচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে চিঠি দিয়েছেন।
ইউরোপে মানব পাচারের অন্যতম রুট বসনিয়া
ইউরোপের সীমান্ত ও উপকূলীয় রক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম বলকানের দেশগুলোকে ব্যবহার করে ইউরোপে মানব পাচারের বিষয়টি প্রথম বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০১৫ সালে।
২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে ৬১ হাজারের বেশি ব্যক্তি পশ্চিম বলকান অঞ্চলের ছয়টি দেশের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন।
ইউরোপের একাধিক দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন থেকে চার বছর ধরে ইউরোপে যেতে অনেক বাংলাদেশি বসনিয়া ও স্লোভেনিয়া যাত্রা করছেন।
অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচার প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া বা স্লোভেনিয়া-ক্রোয়েশিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপে মানব পাচারের অন্যতম পথ (রুট)। মানব পাচারকারী চক্রগুলো লোকজনকে বিভিন্নভাবে ক্রোয়েশিয়া হয়ে বসনিয়া বা স্লোভেনিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে পাঠাতে ভাগ্যান্বেষী এসব মানুষকে বিপজ্জনক যাত্রায় নামায় মানব পাচারকারীরা।
মানব পাচারকারীরা পশ্চিম বলকানের যে ছয়টি দেশের রুট ব্যবহার করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইউরোপে পাচার করে থাকে, বসনিয়া তার অন্যতম। অপর পাঁচটি দেশ হলো—আলবেনিয়া, মন্টেনেগ্রো, কসোভো, উত্তর মেসিডোনিয়া ও সার্বিয়া।
বসনিয়া উদ্বিগ্ন
২০২০ সালে বসনিয়ার জঙ্গলে কয়েকটি দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীর পাওয়ার খবর আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এই দলে বাংলাদেশিরাও ছিলেন। এ নিয়ে বসনিয়ায় শোরগোল শুরু হয়।
মূলত তখন থেকেই অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের ফেরানোর বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ শুরু করে বসনিয়া। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বসনিয়া সফর করে।
সে সময় বেশ কিছু বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির নামে ভ্রমণ পাস ইস্যু হয়। কিন্তু তাঁদের অর্ধেকের বেশি পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকেই আর বসনিয়া থেকে ফেরত আনা হয়নি। এতে বসনিয়া হতাশ হয়।
এখন ইউরোপ যেতে বসনিয়ায় পৌঁছানো বাংলাদেশিদের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে দেশটি এতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে আব্দুল মোমেনকে লেখা চিঠিতে বসনিয়ার নিরাপত্তামন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর দেশ সফর করেছিল। সে সময় সমস্যা সমাধানের উপায় চিহ্নিত করে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে বসনিয়ায় বাংলাদেশিদের উপস্থিতির উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বসনিয়া সরকার চায়, বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যেন সে দেশ সফর করে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। লোকজনের পরিচয় যাচাই শেষে যেন তাঁদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিতে ভ্রমণ-সংক্রান্ত কাগজপত্র জারি করে।
প্রতিনিধিদলের খরচ দেবে বসনিয়া
বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসনিয়া জানিয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সে দেশে উপস্থিত বাংলাদেশির (অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী) সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বসনিয়ার অস্থায়ী অভ্যর্থনাকেন্দ্রে অবস্থানরত এসব লোকজনের সাক্ষাৎকারের পর তাঁদের বাংলাদেশি পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পশ্চিম বলকানের দেশটির মন্তব্য, অবৈধ পন্থায় ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব লোকজন বসনিয়ার জন্য নানা মাত্রায় নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বসনিয়ায় পৌঁছানো বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তাঁদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠাতে পশ্চিম বলকানের দেশগুলোর একটি বিশেষায়িত কর্মসূচিতে অর্থায়ন করছে ডেনমার্ক। বাংলাদেশিদের ফেরত আনার বিষয়ে বসনিয়া সফরের জন্য কোনো প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে গেলে তাদের আকাশপথে যাওয়া-আসার ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সারায়েভো।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. শহীদুল হক গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইউরোপযাত্রার মরিয়া মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তাঁদের ফাঁদে ফেলছে মানব পাচারকারীরা। ইউরোপ পাঠানোর নামে তাঁদের ভূমধ্যসাগরের পাশাপাশি পশ্চিম বলকানের রুট ব্যবহার করে বিপজ্জনক পথে নেওয়ার বিষয়টি কয়েক বছর ধরে সামনে এসেছে। অনিয়মিত ও অবৈধ পন্থায় লোকজন গিয়ে বসনিয়ার মতো দেশগুলোতে আটকে পড়ার কারণে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত সমাধান করা উচিত। সমস্যা জিইয়ে রাখলে তা চাপা পড়ে যাবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপের দেশগুলোতে তা বাংলাদেশের জন্য নানা মাত্রায় সংকট তৈরি করতে পারে।