স্বতন্ত্রদের কাছে হারলেন তিন প্রতিমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের অন্তত ১৯ এমপি

মো. মাহবুব আলী, স্বপন ভট্টাচার্য্য ও এনামুর রহমান
ফাইল ছবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরেছেন তিনজন প্রতিমন্ত্রী। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন ও সম্পাদকমণ্ডলীর দুজন সদস্যসহ বেশ কয়েকজন বর্তমান সংসদ সদস্য নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন ভোটে পরাজিত হয়েছেন। এই হিসাব গতকাল রাত আড়াইটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত। গতকাল ভোট হওয়া ২৯৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে তখন পর্যন্ত ২১৫টির বেসরকারি ফলাফল পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিন প্রতিমন্ত্রীসহ ১৯ জন বর্তমান সংসদ সদস্য ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ২৩ মন্ত্রী, ১৮ প্রতিমন্ত্রী এবং ৩ জন উপমন্ত্রী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩ জন ছাড়া সবাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এর মধ্যে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে পরাজিত করে চমক দেখিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিচিত মুখ ও যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন)। তিনি হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে হারিয়েছেন।

সৈয়দ সায়েদুল হক পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাহবুব আলী পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যও এবার ভোটে জিততে পারেননি। যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে হেরেছেন তিনি। ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা ইয়াকুব আলী পেয়েছেন ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট। স্বপন ভট্টাচার্য পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট।

ঢাকা-১৯ আসনে (সাভার ও আমিনবাজারের একাংশ) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানও ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি তিনজন প্রতিমন্ত্রী। তাঁরা হলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তাঁরা ভোটে অংশ নেননি।

ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমানের (নিক্সন চৌধুরী) কাছে টানা তৃতীয়বারের মতো হারলেন নৌকার প্রার্থী কাজী জাফর উল্যাহ। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাফর উল্যাহ এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো–চেয়ারম্যান ছিলেন।

নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনে পরাজিত হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। তিনি নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের কাছে হেরেছেন। ইফতিকার উদ্দিন পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৮০৩ ভোট। অসীম কুমার উকিল পেয়েছেন ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট।

মাদারীপুর-৩ (সদর একাংশ, কালকিনি ও ডাসার) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়াকে (গোলাপ) বিপুল ভোটে পরাজিত করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (ঈগল প্রতীক) তাহমিনা বেগম। তাহমিনা পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৬৩৩ ভোট। সোবহান পেয়েছেন ৬১ হাজার ৯৭১ ভোট। সোবহান আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক।

মুন্সিগঞ্জ-৩ (মুন্সিগঞ্জ সদর-গজারিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস হেরেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক। এই আসেন জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল (কাঁচি প্রতীক)।

এবারের নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আলোচিত ছিলেন বরগুনা-১ আসনে (সদর-আমতলী-তালতলী) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ (শম্ভু)। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। এবার তাঁকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সরোয়ার।

মানিকগঞ্জ–২ আসনে হেরেছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম। তিনি এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য। তাঁকে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মোতালেব। চট্টগ্রাম–১৬ আসনে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি। এ আসনে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমানকে। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলামের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহীন চাকলাদার। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য ও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁরা ভোটে পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আরও রয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ। তাঁকে গাজীপুর-৫ (সদর-কালীগঞ্জ) আসনে ভোটে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামান।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর–৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মুরাদ হাসানও ভোটে পরাজিত হয়েছেন। অবশ্য এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এই আসনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশীদ। আবদুর রশীদ রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ।

কক্সবাজার–১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম ভোটে হেরেছেন। অবশ্য তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া–১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেনও ভোটে হেরেছেন। নৌকা প্রতীকের এই প্রার্থীকে ভোটে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

কুমিল্লায় হেরেছেন ৪ সংসদ সদস্য

কুমিল্লার ১১টি আসনের মধ্যে ৪টিতেই হেরেছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যরা। এর মধ্যে কুমিল্লা–২ আসনে হেরেছেন সেলিমা আহমাদ। তাঁকে পরাজিত করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল মজিদ। তিনি হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কুমিল্লা–৩ আসনে হেরেছেন ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। এখানে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

কুমিল্লা–৪ আসনে হেরেছেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এখানে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। কুমিল্লা–৫ আসনে হেরেছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আবুল হাসেম। এখানে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ জাহের। তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক।