জমি কেনার আগে সরকারের অনুমোদন নেননি বেনজীর
সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী, চাকরিকালে কোনো সরকারি কর্মচারী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারবেন না। এমনকি আড়াই লাখ টাকার ওপরের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়–বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও পূর্বানুমোদন লাগবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কোনো পূর্বানুমোদন নিয়েছেন কি না, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের কেউ বলতে পারছেন না।
সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানে বের হয়েছে, বেনজীর আহমেদ ডিএমপি কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) ও পুলিশে মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থাকাকালে তাঁর স্ত্রী-সন্তানের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপুল সম্পত্তি হয়েছে। তিনি নিজের নামেও জমি কিনেছেন, কয়েকটি কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন, যা সরকারি চাকরি বিধিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞরা।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা (৩ ও ১৭) অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। তাঁর পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানও ব্যবসা করতে গেলে সরকারের পূর্বানুমোদন লাগবে।
এ বিষয়ে পূর্বানুমোদনের জন্য পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদের যথাযথ কর্তৃপক্ষ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের দপ্তর, সংশ্লিষ্ট শাখার দুজন অতিরিক্ত সচিব এবং দুজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ চাকরিতে থাকাকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোনো অনুমোদন পেয়েছেন, এমন কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট শাখায় নেই।
এ বিষয়ে গতকাল জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলমের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি গতকালই এই পদে যোগ দিয়েছেন, তাই বেনজীর আহমেদের বিষয়টি অবগত নন। তবে তিনি বলেছেন, তিনি যতটুকু জানেন, পরিবারের সদস্যরা যদি সাবেক আইজিপির ওপর নির্ভরশীল হন, তাহলে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নেওয়ার কথা।
বেনজীর আহমেদ ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর অবসরে যান।
এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে বেনজীর আহমেদের নিজ নামে, স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে বিপুল পরিমাণ জমি, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন কোম্পানি ও কোম্পানির শেয়ার রয়েছে। যার বেশির ভাগই অর্জন হয়েছে তাঁর চাকরিকালে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জে সাভানা ন্যাচারাল পার্ক সরকারের যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহ পরিদপ্তরে নিবন্ধিত হয় ২০২২ সালের ১০ মে, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড একই বছর ১ মার্চ, সাভানা ইকো রিসোর্ট ১০ মে এবং একটি শিশিরবিন্দু লিমিটেড নিবন্ধিত হয় একই বছরের ১৮ এপ্রিল। তখন বেনজীর আইজিপি ছিলেন।
ইতিমধ্যে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর, তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনের নামে থাকা ৬২১ বিঘা জমি জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে বেনজীরের নিজের নামে জমি কেনা হয় ৭ দশমিক ৬০ একর (২৩ বিঘা)। তাঁর নামে ২০১৪ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ১৭৫ শতাংশ জমি কেনা হয়। তখন তিনি ছিলেন ডিএমপি কমিশনার।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ছিলেন মোস্তফা কামাল উদ্দিন। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব থাকাকালে বেনজীর আহমেদ র্যাবের ডিজি ও পরে আইজিপি ছিলেন। সরকারি কর্মচারীদের স্ত্রী ও সন্তানের নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে সরকারের যে পূর্বানুমোদন লাগে, তাঁর সময়ে বেনজীর এমন কোনো অনুমোদন নেননি।
মোস্তফা কামাল উদ্দিনের আগে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ছিলেন কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি এখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। কামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সময়কালেও বেনজীর আহমেদ স্ত্রী-সন্তানের নামে প্রতিষ্ঠান খুলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো আবেদন করেননি।
২০১৯ থেকে ২০২১ সময়ে জনপ্রশাসনসচিব ছিলেন শেখ ইউসুফ হারুন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্বে থাকার সময় পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের পরিবারের নামে প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আবেদনের কথা শোনেননি।
বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে জমি কেনা হয়েছে সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অংশীদার পরিচয়ে। বেনজীর পুলিশে চাকরিরত থাকার সময় তাঁর স্ত্রী কোনো পেশায় রয়েছেন বলে জানা যায়নি। তবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত ২০ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ তাঁর ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরিজীবী হলেও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাণিজ্য ও সম্পত্তি অর্জন বাধা হতে পারে না। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মৎস্য খামার রয়েছে।
যদিও ওই ভিডিও বার্তায় সরকারের পূর্বানুমতি নিয়ে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির ১৬ নম্বর ধারায় বলা হয়, সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো কোম্পানি স্থাপন, নিবন্ধন বা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু বেনজীর আহমেদের কয়েকটি কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যেসব সম্পদের হিসাব এখন বের হচ্ছে, এতে বোঝা যায় তিনি এই ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। সরকারের কাছে আবেদনের সময় বলতে হয়, পরিবারের কেউ যদি ব্যবসা করতে চায়, সে টাকার উৎস কী। তিনি সে ঝুঁকি নেননি। কারণ, সরকারি চাকরি করে এত বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়ার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে বেনজীর আহমেদের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক আইজিপির যে পরিমাণ সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে, সেটি অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, তাঁর প্রভাবে যদি স্ত্রী ও সন্তানের ব্যবসা হয়, আয় হয়, সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের কর্তব্য।