ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সূত্র ধরে অর্থ আদায়ের মামলা ঘিরে সর্বোচ্চ আদালতে জয় পেয়েছেন হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। তাঁকে ২০ লাখ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তবে এরই মধ্যে আইনি লড়াইয়ে কেটে গেছে হরেন্দ্রনাথের চার দশক।
ওই মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) আজ সোমবার খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে মামলার ব্যয় বাবদ খরচ হিসেবে তিন মাসের মধ্যে হরেন্দ্রনাথকে ২০ লাখ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুরে গ্রামে বাড়ি হলেও মেয়ে ও জামাতার সঙ্গে এখন ঢাকায় থাকেন হরেন্দ্রনাথ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁর বয়স ৭৮ বছরের বেশি। মামলা চলেছে ৪০ বছর। অস্বাভাবিক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। মামলার কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাহানি হয়েছে।
মামলায় নয়জন বিবাদীর মধ্যে শুধু তিনি বেঁচে আছেন উল্লেখ করে হরেন্দ্রনাথ বলেন, জজ আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে জিতেছেন। মামলা চালাতে গিয়ে জমি ও ভিটে–বাড়িসহ সবই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়ন হলেই আমি খুশি।’
আদালতে হরেন্দ্রনাথের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ওমর ফারুক। সোনালী ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম এ সোবহান।
হরেন্দ্রনাথের আইনজীবী ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ আদায়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে ওই দায় থেকে অব্যাহতি পেলেন হরেন্দ্রনাথ। মামলার সমুদয় ব্যয় হিসেবে খরচা বাবদ ২০ লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে তাঁকে দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।’
অবশ্য সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী এম এ সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করা হবে। আপিল বিভাগের রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পেতে ইতিমধ্যে দরখাস্ত করা হয়েছে।’
হরেন্দ্রনাথের ভাষ্য, স্নাতক পাস করে ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকের ঢাকার একটি শাখায় ১৯৮০ সালের দিকে যোগদান করেন তিনি। পরে তিনি যাত্রাবাড়ী শাখায় কর্মরত অবস্থায় রেমিট্যান্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা শাখা থেকে লোকাল অফিসে পাঠানো হয়। তবে কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে হরেন্দ্রনাথসহ নয়জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৬ সালের মার্চে তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই ঘটনা সূত্রে ‘পকেট ব্যাংকিংয়ের’ অভিযোগে সামরিক আদালতে হরেন্দ্রনাথের সাজা হয়। সাজা ভোগ শেষে ১৯৯০ সালে তিনি কারামুক্তি পান। এর আগে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
আইনজীবীর তথ্য অনুসারে, পরবর্তী সময়ে অর্থ আদায়ে হরেন্দ্রনাথসহ নয়জনের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৯৮৮ সালে নিম্ন আদালতে মামলা (মানিস্যুট) করে। এ মামলায় একতরফা রায়ে নয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে আদেশ দেন প্রথম সহকারী জজ আদালত। এর বিরুদ্ধে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবেদন (বিবিধ মামলা) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত আবেদন গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট আপিল খারিজ করে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত বছর ওই লিভ টু আপিল করেছিল, যা আজ খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।