সেই পাখি এক যুগ পর

লালশির ট্রোগনের ছবিটি ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর থেকে তোলাছবি: লেখক

চোখধাঁধানো লাল মাথার পাখিটিকে প্রথম দেখি ২০১১ সালের ৮ এপ্রিল ফরেস্ট রেঞ্জার প্রয়াত মুনির খানের সঙ্গে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গহিনে। বর্ণিল পাখিটির রূপে এতটাই বিমোহিত ও সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে ক্যামেরায় ক্লিক করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফেরার পর ওটিকে আর খুঁজে পাইনি। এরপর দুটি বছর ওটির খোঁজে কাপ্তাই, আদমপুর, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা কোথায় না গিয়েছি? কিন্তু অত্যন্ত লাজুক ও নিভৃতচারী পাখিটির দেখা পাইনি।

২০১৩ সালের ২৬ মার্চ আবারও আদমপুর গেলাম মুনির খানের স্ত্রী তানিয়া খানের সঙ্গে। অনেকটা পথ পেরিয়ে বনের বেশ গহিনে চলে এলাম। জায়গামতো এসে ক্যামেরা রেডি করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। হার্টবিট বেড়ে গেছে, টানটান উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ও বর্তমানের ডিন অধ্যাপক মো. আলী জিন্নাহ প্রথমবার বার্ডিং ট্রিপে এসে আমার কাছে বর্ণনা শুনেই হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ওই যে দেখুন স্যার, আপনার পাখি এসে গেছে।’ আমি ভাবলাম, বুঝি দুষ্টুমি করছেন। কিন্তু পরক্ষণেই সংযত হলাম। কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে ওর নির্দেশিত দিকে ক্যামেরা তাক করে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলাম। চোখ স্থির হয়ে গেল! বিন্দুমাত্র দেরি না করে এক সেকেন্ডের কম সময়ে মাত্র ছয়টি ক্লিক করলাম। আর কোনো ক্লিকের সুযোগ না দিয়ে লাজুক পাখিটি পালাল।

আদমপুরে দেখা পাখিটি ছিল পুরুষ। স্ত্রীটিকে দেখেছিলাম মাত্র একবার, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড়ছড়ার পাশে পাহাড়ের একটি খাদে দাঁড়িয়ে। তবে ছবি তুলতে পারিনি। ক্লিক করার আগেই খাদের পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম। ক্যামেরারও বেশ ক্ষতি হয়েছিল। এর পরও বেশ কয়েক বছর পাখিগুলোর ছবি তোলার চেষ্টা করেছি কালেঙ্গা, আদমপুর ও কাপ্তাইয়ে; কিন্তু দেখা পাইনি।

১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে আবারও আদমপুরে গেলাম। ফিরতি পথে বিরল গর্দাপেয়ারি প্রজাপতির ছবি তুলছিলাম। এমন সময় দলের সদস্য মুশফিকুর রহমান তালুকদারের ডাকে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম! আগে না দেখেও মুশফিক আবিষ্কার করল স্ত্রী-পুরুষ দুটি পাখিকে একসঙ্গে। কিন্তু পাখিগুলো ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকায় ছবি তুলতে বেশ কষ্ট হলো। পুরুষটির ছবি তোলার প্রায় এক যুগ পর স্ত্রীটির ছবি তুলতে সক্ষম হলাম।

চোখধাঁধানো লাল মাথার পাখিটি এদেশের অতিসুন্দর ও বিরল আবাসিক পাখি লালশির, লালমাথা, লালশির ট্রোগন নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে পুরুষটি সাদাসোহাগী ও স্ত্রীটি কুচকুচিয়া নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম ‘রেড হেডেড ট্রোগন’। ট্রোগনিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Trogon erythrocephalus. বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ পাখি দেখা যায়।

প্রাপ্তবয়স্ক লালশির ট্রোগন লম্বায় ৩৪ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ৭৫ থেকে ১১০ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষে পার্থক্য থাকে। পালকের মূল রং বাদামি। পুরুষের পিঠ মরচে বাদামি; পেট ও তলপেট গোলাপি। মাথা, ঘাড় ও বুক গাঢ় লাল; বুকে একটি সাদা ফিতা। ডানার পালক-ঢাকনি কালো ও ধূসর সূক্ষ্ম দাগে ভরা। চারকোনা লেজটি বেশ লম্বা, যা ক্রমে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া। লেজের পালকের ওপরটা বাদামি ও নিচটা সাদা-কালো। পুরুষটির চোখ হালকা লালচে নীল রিংয়ে ঘেরা। অন্যদিকে স্ত্রীটির মাথা, ঘাড় ও বুক দারুচিনিরঙা। ডানার পালকঢাকনির সূক্ষ্ম দাগগুলো বাদামি হলুদ। চোখের রিং নীল। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষ চোখ ধূসর। চঞ্চু দুই রঙা; ওপরেরটি বেগুনি নীল ও নিচেরটি কালো। পা ও পায়ের নলা বেগুনি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক, পেট ও তলপেট হলদে সাদা।

লালশির ট্রোগন সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনের বাসিন্দা। একাকী বা জোড়ায় থাকে। পা বেশ দুর্বল হওয়ায় হাঁটাহাঁটি করে কম। ভালো উড়তে পারলেও তেমন একটা ওড়াউড়ি করে না। পোকামাকড়, শূককীট ও রসাল ফল পছন্দ করে। গাছের ডাল থেকে উড়ে উড়ে বা মাটিতে নেমে পোকামাকড় ধরে খায়। অত্যন্ত শান্ত, লাজুক ও নিভৃতচারী পাখিটি গাছের আড়াল থেকে নম্র মধুর স্বরে ‘কিউ-কিউ...’, ‘টিয়াউপ-টিয়াউপ...’ বা ‘কি-কি-কি-কি-কিউ...’ শব্দে ডাকে। 

এপ্রিল থেকে জুলাই লালশির ট্রোগনের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে মাটি থেকে ১ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ০ মিটার উচ্চতায় কোনো প্রাকৃতিক কোটর বা কাঠঠোকরা, বসন্তবাউরির পরিত্যক্ত গর্তে এ পাখি বাসা বাঁধে। চকচকে ক্রিম রঙের ৩ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে, যা ১৮ দিনে ফোটে। আয়ুষ্কাল সাত থেকে আট বছর।