গভীর সাগরে মৎস্য গবেষণা
জাহাজের খবর নেই, ক্যামেরা কেনা শেষ
বিধি লঙ্ঘন করে ক্যামেরা কেনায় আপত্তি তুলেছে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ কোটি টাকার বেশি। পুরোটাই দেবে সরকার।
মেয়াদ শেষ হওয়ার সাত মাসের কম সময় বাকি। প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
গভীর সাগরে টুনা ও এ–জাতীয় ‘পেলাজিক’ মাছ (পানির উপরিভাগের কাছাকাছি থাকা মাছ) কী পরিমাণে আছে, তা জানতে গবেষণা হবে। এ জন্য তিনটি জাহাজ কেনার কথা। এখনো জাহাজ কেনা হয়নি। কবে কেনা হবে, তা–ও জানে না মৎস্য অধিদপ্তর। কিন্তু জাহাজে ব্যবহারের জন্য তিনটি ক্যামেরা কেনা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে।
এদিকে ক্যামেরাগুলো সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে কার্যকর কি না, কেনার আগে সে বিষয়টিও যাচাই করে দেখা হয়নি। বিধি লঙ্ঘন করে এভাবে ক্যামেরা কেনায় আপত্তি তুলেছে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকলে ক্যামেরাগুলো অকেজো হয়ে যেতে পারে।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের জুনে পানির নিচে স্থিরচিত্র ধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাগুলো কেনা হয় ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে। অথচ জাহাজ কেনার অনুমতি ও অর্থ বরাদ্দ আগামী অর্থবছরেও হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের চলতি অর্থবছরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলসের বিধি-১০৩ অনুযায়ী বরাদ্দের তামাদি এড়াতে বা পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ রয়েছে বিবেচনায় নিয়ে কোনো ব্যয় করা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী। বিধি-১৫২ অনুযায়ী প্রকৃত প্রয়োজনের আগে ভান্ডার সামগ্রী কেনা যাবে না। ওই প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুটি বিধিই লঙ্ঘন করে ক্যামেরা কেনা হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিনটি জাহাজ কেনার জন্য বরাদ্দ ২৭ কোটি টাকা। সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজ তিনটি সরবরাহের কাজ পেয়েছে।
জাহাজের আগে কেন ক্যামেরা কিনলেন, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. জুবায়দুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যামেরা কিনেছি। ২০২২ সালের আগস্টে জাহাজ আসার কথা ছিল। তবে ওই বছরের জুলাইয়ে সরকার এক পরিপত্র জারি করে জানায়, জলযান, আকাশযান ও যানবাহন কেনা যাবে না। এতে বরাদ্দ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় আর জাহাজগুলো কেনা সম্ভব হয়নি। যদি আগামী অর্থবছরেও সরকার জাহাজ কেনা বন্ধ রাখে, তাহলে আমি কী করব?’
লবণাক্ত পানিতে ক্যামেরার কার্যকারিতা নিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি যাচাই করার সুযোগ ছিল না। ক্যামেরার নির্দিষ্ট সময়ের ওয়ারেন্টি আছে।’
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালে জাহাজ পাওয়া যাবে, এ বিবেচনায় ক্যামেরা কেনা হয়েছে বলে যে জবাব প্রকল্প পরিচালক দিয়েছেন, তা আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিরীক্ষার সময় (২০২২ সালের নভেম্বর মাসে) জাহাজ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য এখনো সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় জাহাজ আসা ও এর ব্যবহার শুরু করার আগেই ক্যামেরার ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হবে।
মেয়াদ প্রায় শেষ, নেই উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি মৎস্য অধিদপ্তরের এই প্রকল্পের অগ্রগতিও অত্যন্ত হতাশাজনক। ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। আর সাত মাসের চেয়ে কম সময় থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
জাহাজের ক্রুসহ টুনা আহরণের জন্য ১০০ জনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ প্রকল্পে। টুনা ও সমজাতীয় মাছের প্রাপ্যতা, আহরণ ইত্যাদি বিষয়ে ২৬ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে এখানে।
প্রকল্পের উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি না হওয়া প্রসঙ্গে জুবায়দুল আলম বলেন, জাহাজ কেনার সঙ্গে প্রকল্পের অন্যান্য কাজ সম্পৃক্ত। যেহেতু জাহাজ কেনা হয়নি, তাই অন্য কাজও করা যাচ্ছে না। এর মানে চলতি মেয়াদে এ প্রকল্প শেষ হচ্ছে না।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে এখনো কোনো পরিকল্পনা করেননি প্রকল্প পরিচালক। সে ক্ষেত্রে এর ভবিষ্যৎ কী, জানতে চাইলে জুবায়দুল আলম বলেন, ‘সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।’
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ কোটি টাকার বেশি, যার পুরোটাই দেবে সরকার।
কেন এই প্রকল্প
আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ২০১২ সালে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সামুদ্রিক জলসীমার ২০ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চল, ৩৫ শতাংশ অগভীর সাগর, বাকি ৪৫ ভাগ গভীর সাগর। দেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এলাকার প্রায় সবটুকুই উপকূলীয় ও অগভীর সাগরের।
গভীর সাগর ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা এবং এ–জাতীয় মাছ আহরণে কার্যকর কোনো কার্যক্রম চলমান নেই। সরকারিভাবে বেসরকারি মৎস্য খাতকে এসব মাছ ধরায় উৎসাহিত ও সম্পৃক্ত করতেই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. জোবায়ের আলম বলেন, এ জরিপ পরিচালনার জন্য ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে ততটা প্রয়োজন নয়। এর জন্য বেশি প্রয়োজন জাহাজের। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সোনার (sonar) প্রযুক্তি (শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে সমুদ্রের তলদেশ সম্পর্কে ধারণা লাভের প্রযুক্তি)।
তবে জানা গেছে, জরিপের জন্য সোনার প্রযুক্তি বা এ ধরনের অন্য কোনো প্রযুক্তি কেনার সংস্থান রাখা হয়নি প্রকল্পে।