জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত বন্ধু : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ফাইল ছবি: বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানকে বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত বন্ধু উল্লেখ করে বলেছেন, স্বাধীনতা অর্জনের দুই মাসের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে এই দেশ তাঁর হৃদয়ের খুব কাছের।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাপান আমাদের বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশ তার উন্নয়নের জন্য জাপানের অবিচল সমর্থন পেয়েছে এবং আমাদের স্বাধীনতার পর জাপানের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা পেয়েছে।’

বাসসের খবরে বলা হয়, ‘জাপান আমাদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে’ শিরোনামে নিজের লেখা একটি নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর চার দিনের জাপান সফরের দ্বিতীয় দিন সে দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য জাপান টাইমস’–এ এই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫১তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে আমার দেশ, বাংলাদেশ এবং জাপানের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে আমি আবার টোকিওতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মহামান্য সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আমাকে আমন্ত্রণের জন্য প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকেও শ্রদ্ধা জানাই। আবে ছিলেন বাংলাদেশের একজন মহান বন্ধু।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা লাভের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে জাপান অন্যতম। তিনি লিখেছেন, ‘এমনকি ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জাপান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়েছে, যা আমরা কখনো ভুলিনি বা ভুলব না।’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে অবিস্মরণীয় ঘটনা ছিল জাপানি স্কুলের শিশুরা তাদের টিফিনের টাকা জমা করে সেই টাকা ঘূর্ণিঝড় এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের লোকদের জন্য সাহায্য করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারপর থেকে জাপান আমাদের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছে। জাপান আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটি দেশ, ঠিক যেমন এটি আমার পরিবার এবং আমাদের জনগণের কাছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার ছোট বোন শেখ রেহানা জাপানের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত কারণ, সে আমাদের বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমাদের ছোট ভাই শেখ রাসেলের সঙ্গে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে প্রথম জাপান সফর করেছিল।’

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। টোকিও, জাপান, ২৬ এপ্রিল
ছবি: বাসস

তিনি বলেন, জাপানের প্রতি তাঁর বাবার স্পর্শকাতরতার উত্তরাধিকার লালন করার পাশাপাশি দেশটির বিস্ময়কর উন্নয়নের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমি অনুভব করি, আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক একটি ঈর্ষণীয় স্তরে জোরদার করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের ব্যাপক অংশীদারত্ব থেকে একটি কৌশলগত অংশীদারত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।’

জাপানের বিনিয়োগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রতিক ওডিএ ঋণ প্যাকেজে জাপান বাংলাদেশকে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি সহজ শর্তে ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দ্বিমুখী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।’

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ট্রেনলাইন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং আড়াইহাজারে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ জাপান বাংলাদেশের কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের এমআরটি লাইনের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় কাজ করার সময় কিছু জাপানি প্রযুক্তি–বিশেষজ্ঞ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় সন্ত্রাসীদের হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন।’ তিনি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার পর্বগুলোর একটি। আমি অনেক দুঃখের সঙ্গে তাঁদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছি এবং আবারও তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এই দুঃখজনক ঘটনা সত্ত্বেও আমাদের জাপানি বন্ধুরা প্রকল্প থেকে সরে আসেননি; বরং এর পরিবর্তে নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ঢাকায় দেশের প্রথম এমআরটি লাইন-৬, স্থাপন করা হয়, যা গত ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমার মেয়াদের গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক অগ্রগতি অর্জনে অনেক দূর এগিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ আর দারিদ্র্যপীড়িত নয়; বরং এটি এখন উন্নয়নের বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এখানে দেড় দশকে মাথাপিছু আয় পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাদ্যনিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত মঙ্গলবার টোকিওর হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়
ছবি : বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সহনশীল এবং বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ, বাংলাদেশের উদার নীতি ও আইন বিনিয়োগের জন্য অনুকূল এবং উৎসাহজনক।

এর মধ্যে রয়েছে এফডিআই–সম্পর্কিত আর্থিক নীতি, কর সুবিধা, রপ্তানির জন্য প্রণোদনা এবং একটি তরুণ, প্রতিযোগিতামূলক শ্রমশক্তি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগ, যা দেশীয় এবং বিশেষ করে বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

রোহিঙ্গা ইস্যু সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ জোরপূর্বক মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখ নাগরিককে দেখাশোনা করতে গিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে লিখেছেন, ‘গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গা নামে পরিচিত এই লোকদের বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের দীর্ঘ উপস্থিতি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। এখন তারা বাংলাদেশসহ সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। জাপান, এই অঞ্চলে তার ফলপ্রসূ প্রভাবের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করতে পারে এবং এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে সাহায্য করতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের সহযোগিতা এবং বন্ধুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এবং সমৃদ্ধ হবে।’

আরও পড়ুন