‘রাত তখন সোয়া ১২টা। সাগর উত্তাল। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। তাকিয়ে দেখি ট্যাংকারের মাঝামাঝি অংশ থেকে সামনের দিকে চার জায়গায় আগুনের ফুলকি উড়ছে। প্রথমে ট্যাংকারের বাঁ থেকে ডানে। এরপর আবার বাঁ থেকে ডানে। যে চারটি জায়গা থেকে আগুনের ফুলকি উড়েছে, দাগ টানলে অনেকটা ইংরেজি জেড অক্ষরের মতো হবে। ফুলকি উড়তে দেখে হতচকিত হয়ে যাই। এরপরই মুহূর্তের মধ্যে ট্যাংকারের ডেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভয় ছিল, যদি কোনো কারণে ট্যাংকারের যেখানে তেল মজুত রয়েছে, সেখানে আগুন লাগে, তাহলে কেউ জীবিত ফেরার আশা থাকবে না।’
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ নামের ট্যাংকারে গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে আগুন লাগার ঘটনা এভাবেই প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেছেন ট্যাংকারটির প্রধান প্রকৌশলী রাশেদুল হাসান। এ দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৪৭ নাবিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে।
আজ শনিবার সকালে ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়ে বিএসসি কার্যালয়ে আসেন এই কর্মকর্তা। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম ওপরের ডেকে। আগুনের ফুলকি দেখে শুরুতেই ৯৯৯, বন্দর, কোস্টগার্ডসহ সব জায়গায় আমাদের উদ্ধার করার জন্য বার্তা দিই। আগুন যাতে পুরো ট্যাংকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য ডেকের সঙ্গে যুক্ত বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ বন্ধ করে দিই। আমরা লাইফ জ্যাকেট পরে প্রস্তুতি নিই।’
রাশেদুল হাসান আরও বলেন, ‘আগুন যখন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন নাবিকেরা উদ্ধারের আশায় ট্যাংকারের এক পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন। আগুনের ভয়াবহতা দেখে একপর্যায়ে মাস্টার ট্যাংকারটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। সে মুহূর্তে একটি মাছ ধরার নৌযান ছুটে আসে। এরপর কোস্টগার্ডের নৌযানও আসে। প্রথমে আমরা একদল এসব নৌযানে উঠি।’
উদ্ধার হওয়া ট্যাংকারটির চতুর্থ প্রকৌশলী শেখ সাদি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল সকালে। সকালে জাহাজটি বন্দরের জেটিতে ভেড়ানোর কথা। এ জন্য রাতের কাজ শেষে আমি কেবিনে ঘুমাতে যাই। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম থেকে উঠে যাই। কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি, ডেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।’
গতকাল মধ্যরাতে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখনো ভুলতে পারছেন না উদ্ধার হওয়া নাবিকেরা। পাঁচ দিনের ব্যবধানে শিপিং করপোরেশনের দুটি ট্যাংকারে আগুনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ এমটি বাংলার সৌরভে দুর্ঘটনায় নিহতের নাম সাদেক মিয়া (৫৯)। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীতে।
ট্যাংকারটিতে যখন আগুন লাগে, তখন সেখানে ৪৮ জন ছিলেন। এর মধ্যে ৪২ জন নাবিক, ইস্টার্ন রিফাইনারির দুজন প্রতিনিধি, জাহাজের পাহারাদার ছিলেন তিনজন ও জাহাজের রসদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধি। সাদেক মিয়া ছাড়া বাকি ৪৭ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। তাঁরা নৌবাহিনীর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার সময় ট্যাংকারটিতে ১১ হাজার টন জ্বালানি তেল ছিল। তবে জ্বালানি তেল যেখানে ছিল, সেখানে আগুন লাগেনি। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বন্দরের সাতটি টাগবোট গতকাল দিবাগত রাত ২টা ৪০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।