আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে প্রতিটি বইয়ের জন্য দুটি করে পিএইচডি দেওয়া যায়: সলিমুল্লাহ খান
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ইতিহাসকে যেভাবে সাধনা করেছেন, তাতে তাঁর আগে যে বা যাঁরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন, তার সবই বাতিল হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন লেখক-অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত প্রতিটি বইয়ের জন্য তাঁকে দুটি করে পিএইচডি দেওয়া যায়। প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রাচীনপন্থী বা রক্ষণশীল ছিলেন না।
বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সলিমুল্লাহ খান এসব কথা বলেন। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের প্রবন্ধকার সলিমুল্লাহ খান বলেন, ২১ বছর পর বাংলা একাডেমির মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা শিক্ষার্থীদের যেসব পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রি দেন, সেগুলো প্রকাশ করা হলে দুর্নাম রটে যেত এবং কেলেঙ্কারি হতো বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
৩০ বছর ধরে বাংলা ভাষার ওপর ‘অসাধারণ বর্বরতা’ চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মের জন্য নতুন কমিটি গঠন করার অনুরোধ করে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘এটা করা দরকার। যে অকারণ সংস্কার করা হয়েছে, এটার নাম হচ্ছে অত্যাচার। এর একটা সীমা থাকা উচিত। ভাষার যাঁরা ভ-ও জানে না, তারা ভাষার ওপর কর্তৃত্ব করলে যে দুর্দশা হয়, সেটি আমরা পড়েছি। এটার একটা ইনকোয়ারি (তদন্ত) হওয়া দরকার। জেনারেল এরশাদের আমলে এই অপকর্ম শুরু হয়েছিল। মাত্র পাঁচজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে একটা কমিটি করে ভাষার ওপর তারা সংস্কার করেছে। তাদের একমাত্র দোহাই রবীন্দ্রনাথ।’
সলিমুল্লাহ খান বলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ইতিহাসকে যেভাবে সাধনা করেছেন, তাতে তাঁর আগে যে বা যাঁরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন, সব বাতিল হয়ে গেছে। আবদুল করিমের আসল অবদান হলো বাংলার ইতিহাসের পুনর্গঠন। বাংলার ইতিহাসের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তাঁকে ঐতিহাসিক না বলার যে সাহস সরদার ফজলুল করিমের হয়েছিল, সেটি তাঁর দোষ নয়। এটি ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভয়ানক ও ক্ষতিকর। সলিমুল্লাহ খান বলেন, আবদুল করিমের মতো একজন সেরা বাংলা গদ্যলেখক নেই। প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রাচীনপন্থী বা রক্ষণশীল ছিলেন না। তিনি মারাত্মক আধুনিক ছিলেন, যা এমনকি দোষের পর্যায়েও গিয়েছে।
আবদুল করিম সম্পাদিত প্রতিটি বইয়ের জন্য তাঁকে দুটি করে পিএইচডি দেওয়া যায় বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, তাঁর আটটি বইয়ের মধ্যে মাত্র দুটি বই হচ্ছে মুসলিম লিখিত। বাকি সবই হিন্দুদের লেখা। তিনি হিন্দু-মুসলমান ভেদ করে সাহিত্য রচনা শুরু করেননি। পুঁথি সংগ্রহের ক্ষেত্রেও এই ভেদাভেদ করেননি তিনি।
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের স্থান দুনিয়ার যেকোনো দেশের সেরা ইতিহাসবিদদের মধ্যে। কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগে যে কয়জন অগ্রণী চিন্তাবিদ বাঙালি মুসলমান সমাজে জন্মগ্রহণ করেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁদের মধ্যমণি। সাহিত্যবিশারদ সম্পাদনা করে জমা দিয়েছেন, সেগুলোও লোকজন তছরুপ করেছে—এ রকমও হয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের লেখার মধ্যে যে পুঁথিসাহিত্য কথাটা পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে হাতে লেখা পুঁথি বা পাণ্ডুলিপি। কিন্তু বাংলা সাহিত্য আঠারো-উনিশ শতকে চর্চিত কলকাতার বটতলায় ছাপা হওয়া পুঁথিসাহিত্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পছন্দ করতেন না। তিনি ইতিহাসকে দেখতেন একটা ধারাবাহিকতা হিসেবে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে একটু পাবলিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি। অপেক্ষাকৃত বেশি আলোচক সংযুক্ত করা এবং পরে সবকিছু নিয়ে বই প্রকাশ করার বিষয়টিকে আরেকটু জোরালো করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করব, এর একটা সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়বে এবং চর্চাটা বিস্তৃত হবে।’
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ। আরও বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব (যুগ্ম সচিব) মোহা. নায়েব আলী।