পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারী অধিকার নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে: অধ্যাপক নায়লা কবীর

অধ্যাপক নায়লা কবীর নিজের বইয়ের ওপর একক আলোচনায় কথা বলেন।তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ঢাকা, ২ জানুয়ারিছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন আন্তর্জাতিক শাসন সূচকে তলানিতেই অবস্থান করেছে। এর পেছনের কারণ দুর্নীতি ও অসমতা। শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেকর্ড দুর্বল—জুলাই বিপ্লব থেকে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীতে নিজের বইয়ের ওপর একক আলোচনায় এসব কথা বলেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক নায়লা কবীর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আয়োজনে বিআইডিএস মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়েছে।

নায়লা কবীরের বইয়ের নামে আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘পুরুষতন্ত্র নিয়ে পুনরায় আলোচনা: লিঙ্গ, সংস্থা ও বাংলাদেশ প্যারাডক্স’। প্যারাডক্স হলো আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়—এমন বক্তব্য বা মত। ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ হিসেবে যা বর্ণনা করা হয়, তা হলো নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির অপ্রত্যাশিত গতি। ‘সংস্থা’ বলতে বোঝানো হয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নেতৃত্ব ও সমন্বিত পদক্ষেপে নারীর সক্ষমতার বিষয়।

নায়লা কবীর বলেন, এ দেশের নারীরা পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিজের জীবনে পরিবর্তন এনে এগিয়েছে। তাই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এই সময়ে নারীর অগ্রগতি ধরে রাখতে তাদের অধিকার নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল চরম বৈষম্যের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান বিদেশি মুদ্রা বেশি আয় করলেও বেশির ভাগ বাজেট ও বিদেশি সহায়তা নিয়ে যাওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতার পর বিশ্বে রুয়ান্ডা ও ইথিওপিয়ার পর বাংলাদেশই ছিল সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। তিনি আরও বলেন, আশির দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয়, শিশু মৃত্যু কমে, নারীর গড় আয়ু বাড়ে। তিনি বলেন, নব্বই দশক থেকে প্রাথমিক স্কুলে মেয়েশিশু ভর্তি বাড়ে। আগে পরিবারে ছেলেসন্তানের বিষয়ে অগ্রাধিকার যতটা শক্তিশালী ছিল, এখন তা তুলনামূলক কমেছে। অনেক বাবা–মা এখন বলেন, মেয়ে উপার্জন করলে বৃদ্ধ বয়সে মেয়ে তাঁর বাবা–মাকে দেখভাল করেন। এই মানসিকতা থেকে তাঁরা মেয়েসন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগ করছেন। এই অর্জনগুলোকে উদ্‌যাপন করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নায়লা কবীর। তিনি বলেন, এখনো সম্পত্তির ওপর সমান অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত। নারীকে পর্দাপ্রথার মধ্যে রাখার মনমানিসকতা এখনো অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এই সময়ে নারীর অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়, সে লক্ষ্যে প্রতিটি মতবাদের পক্ষের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কেন নারী–পুরুষনির্বিশেষে অনেকেই মনে করেন যে পুরুষেরা নেতৃত্ব দিতে পারে, নারীর চেয়ে পুরুষের শিক্ষা বেশি জরুরি—তা জানতে আরও বিশদ গবেষণা করা প্রয়োজন। নারী শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।

বইয়ের ওপর আলোচনায় নায়লা কবীর বাংলাদেশ প্যারাডক্সের রাজনৈতিক মাত্রা নিয়ে বলেন, বাংলাদেশে সামরিক বা বেসামরিক শাসন, গণতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নির্বিশেষে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশে অত্যন্ত নিম্নমানের শাসনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। শাসন ​​এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার দিক দিয়ে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে নিচের ২০ শতাংশ দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হয়েছে।

অধ্যাপক নায়লা কবীর বলেন, ‘আমরা শুধু প্যারাডক্স হিসাবে বিবেচিত ছিলাম। কারণ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আধুনিকীকরণ এবং জনসংখ্যাগত পরিবর্তনগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর ধারণার সঙ্গে মেলেনি। আমাদের গল্পটি আমাদের ইতিহাসের অংশ হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কাঠামো এবং সংস্কৃতির একত্রিত হওয়ার ফল। বাংলাদেশ প্যারাডক্স টেকসই কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশকে যা প্যারাডক্স বানিয়েছে, তা আমাদের ধারণার তুলনায় ততটা পরিবর্তন হয়নি।’

বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে উল্লেখ করে নায়লা কবীর বলেন, যদিও পরিসংখ্যানগুলো এখন কম নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে সম্পদকে শীর্ষে কেন্দ্রীভূত রাখা, চাকরির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির দুর্বল নকশা, ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসন, নারী–পুরুষের জন্য বেশির ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকায় অসমতার হার একই রয়ে গেছে। ফলে আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে এবং হতাশাও ঢুকেছে।

বাংলাদেশে শাসনের ক্ষেত্রে রেকর্ড দুর্বল থেকে গেছে, সেটা জুলাই বিপ্লব থেকে স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন নায়লা কবীর। তিনি বলেন, ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ের ধারাবাহিক ব্যর্থতা রয়েছে। এর ফলে প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুসারে, সংখ্যালঘুদের প্রতি বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সহনশীল মুসলিম দেশ। তবে এটা আরও ভালো হতে পারত। বাংলাদেশ এখন একটি পরির্বতনশীল অবস্থায় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন আশায় পরিপূর্ণ। আতঙ্কের পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যাকে এখন কি ঠিক করতে পারি? এসব বিষয় কি আগের মতোই চলবে, শুধু ভিন্ন দল ক্ষমতায় আসবে? নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি কী হবে? কারণ সব রাজনৈতিক শক্তি এসব বিষয়ে একইভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। আমার বই কি অগ্রগতির গল্পের শেষ অধ্যায়ের অংশ হবে নাকি এটি আরও গণতান্ত্রিক ও নতুন গল্পের সূচনা হবে?’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। বইয়ের মূল বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্যারাডক্স নিয়ে দুই দশক ধরে সবাই শুনেছে, আলোচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্যারাডক্স থেকে নারীর আকাঙ্ক্ষার কথা কেউ ভালোভাবে বুঝতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে একটি রক্ষণশীল দেশের আবহে থেকে নারীরা নিজেদের জীবনে পরিবর্তন এনেছে, জাতীয় অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। দুর্বৃত্ত, দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তার মধ্যেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। উন্নত দেশ একটির পর একটি খাতে যেমন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিল্প উন্নয়ন, শিক্ষা ইত্যাদিতে ধাপে ধাপে পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে একই সঙ্গে এই বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে নারীরা পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের বিষয়টি মাথায় রেখে নিজেদের ক্ষতি যতটা কম হয় সে লক্ষ্যে পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এগিয়েছে। এই গল্পগুলো বলা দরকার। সহিংসতাসহ এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে নারী।