কারও ৪৫০, কারও ৩০০, বিএনপি নেতাদের কার বিরুদ্ধে কত মামলা
বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখা এ হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে।
ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোয় সকালে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে আসেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান। তিন মাস ধরে এটা তাঁর রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৪৫০। একেক দিন শুনানি থাকে চার থেকে পাঁচটি মামলার।
প্রায় একই রকম রুটিন (নিয়মিত কাজ) বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (আলাল), বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমানের (শিমুল বিশ্বাস)। রিজভীর মামলা ১৮০টি। আলালের বিরুদ্ধে আড়াই শ আর শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দেড় শর বেশি মামলা রয়েছে।
বিএনপির নেতাদের মামলা পরিচালনা করেন এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতাধিক মামলার আসামি এমন নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাইকে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে আসতে হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাই আছেন শতাধিক।
বিএনপির আইনজীবীরা বলছেন, সরকারের শেষ সময়ে এসে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলার বিচারের গতি বেড়ে যাওয়ায় কারাগারের থাকা নেতাদের অনেককেও প্রায় প্রতিদিন আদালতে হাজির করা হচ্ছে। এমন একজন হচ্ছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সভাপতি এবং উপনির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৩১৭টি মামলা রয়েছে। দুই মাস ধরে প্রায় প্রতিটি কার্যদিবসে জাহাঙ্গীরকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আনা-নেওয়ার ফলে জাহাঙ্গীরসহ অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। একই অবস্থা যুবদলের সাবেক সভাপতি কারাবন্দী সাইফুল আলমেরও (নিরব)। তাঁর বিরুদ্ধেও সাড়ে তিন শর বেশি মামলা রয়েছে।
ঢাকার আদালতগুলোর মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এরই মধ্যে ছয়টি মামলায় বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড হয়েছে। আরও ২০০ মামলার বিচার দ্রুত এগোচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টির বিচার শেষ পর্যায়ে। ১৭০টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এসব মামলায় কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন।
বিএনপির নেতাদের আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার অভিযোগে করা মামলাগুলোর বিচার দ্রুত এগোচ্ছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা দেওয়া হয়। ‘গায়েবি মামলা’ নামে পরিচিতি পাওয়া ওই সব মামলার অনেকগুলো এখন বিচারের পর্যায়ে রয়েছে।
আবারও নামমাত্র নির্বাচন করতে আদালতকে ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের সাজা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার।মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে সরকার একের পর এক মামলা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি আন্দোলন ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে থাকা পুরোনো মামলার নিষ্পত্তি করে সাজা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রসিকিউশন বিভাগকে পুরোনো মামলা আগে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে বলেছি। পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তার সবই নেবে সরকার। এখানে আলাদা করে বিএনপির নেতাদের মামলা নিষ্পত্তির কোনো নির্দেশনা আমরা দিইনি।’
বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলা রয়েছে বলে দাবি বিএনপির।
গত আগস্ট মাসেই আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে ৫৩টি মামলায় শুনানির দিন ধার্য ছিল। গড়ে দুটির বেশি মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল ঢাকার আদালতে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতায় আসার পর সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার গায়েবি মামলা দিয়েছে সরকার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আবারও নামমাত্র নির্বাচন করতে আদালতকে ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের সাজা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার।
মামলা জালে কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাই
বিএনপির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই মামলার আসামি। এর মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগেই সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা ৯৮টি। তিনি গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘আমার নামে ৯৮টি মামলা। আর দুটি হলে সেঞ্চুরি হবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মির্জা আব্বাসের মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে করা মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এ সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় খন্দকার মোশাররফের মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ হয়েছে। সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হলেই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে যাবে। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বিচারাধীন। দুদকের কৌঁসুলি (পাবলিক প্রসিকিউটর) মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ অসুস্থ হয়ে বিদেশে যাওয়ায় মামলার নিষ্পত্তিতে বিলম্বে হয়েছে। এখন তিনি দেশে ফিরেছেন। আশা করি, দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বাস পোড়ানোর একটি মামলায় সম্প্রতি অভিযোগ গঠন হয়েছে। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিচার চলছে।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা শেষ পর্যায়ে আছে। ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন মামলার আটজন সাক্ষীর মধ্যে সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান ও ২০১৮ সালে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী (ধানের শীষ) আহসান হাবীবের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে করা মামলাটির রায়ের তারিখ ধার্য রয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর।
খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের ২৫টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ দ্রুতগতিতে চলছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে আদালতে হাজির হতে হয়। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর ও গত রোববার তাঁকে আদালতে হাজির হতে দেখা গেছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীরের বিরুদ্ধে থাকা পাঁচটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে আছে। সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী) রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা, এর মধ্যে ১০টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে।
পুরোনো মামলা আগে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে বলেছি। আলাদা করে বিএনপির নেতাদের মামলা নিষ্পত্তির কোনো নির্দেশনা আমরা দিইনি।আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের বিরুদ্ধে মামলা ৮০টি, এর মধ্যে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে ১০টি মামলা। একই কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা ১২৭টি। তাঁর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ৫০টি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তানভীরের বাবা সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আছে দেড় শ মামলা। এর মধ্যে ৬০টিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। দুজনকেই কারাগার থেকে নিয়মিত আদালতে হাজির করা হচ্ছে।
বিএনপির নেতাদের আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ঢাকায় বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা দুই শতাধিক মামলার তালিকা তৈরি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নিয়মিত সাক্ষী হাজির করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫০ বছরের আইন পেশায় দেখেনি, একজন রাজনৈতিক নেতার নামে কোনো সরকার তিন শ, চার শ মামলা দিতে পারে।’ তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে বিএনপি নেতাদের অযোগ্য করতে সরকার আদালতকে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি সন্ধ্যার পরও রাজনৈতিক মামলায় সাক্ষ্য নিতে দেখা গেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুটি মামলায় সাজা দেন ঢাকার আদালত। তাঁর আরও তিনটি মামলার বিচার চলছে।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির নেতারা যা বলছেন, তা সঠিক নয়। কয়েক বছরের পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করছে। বিএনপি নেতাদের কোনো মামলা নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ কাজ করছে না।’
৪৪ নেতা-কর্মীর সাজা
ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত আট মাসে ছয়টি মামলায় বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতা-কর্মীর সাজা দিয়ে রায় হয়েছে। তাঁরা মূলত ঢাকা মহাগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মী।
এর মধ্যে আট বছর আগে গুলশান এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিনসহ (জুয়েল) তিনজন বিএনপি নেতাকে কারাদণ্ড দেন আদালত।
১০ বছর আগে সবুজবাগে ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার মামলায় গত ১৯ জুন বিএনপি নেতা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হামিদুর রহমানসহ সাতজনের দুই বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফলাফল খুব খারাপ হয়।শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
আর ১০ বছর আগে মুগদা এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় গত ৩ এপ্রিল বিএনপির আরও সাতজন নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড দেন আদালত।
গত ৭ আগস্ট যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ২১ জনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানা এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে মামলাটি ছিল।
গত ১৭ আগস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাসাস সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহসহ পাঁচজনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট রমনা থানার একটি মামলায় আবুল কালাম আজাদ নামের একজন বিএনপির কর্মীকে সাজা দিয়েছেন আদালত।
স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ (আমান) ইতিমধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত। ইকবাল হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে সম্প্রতি।
সাত বছর আগে মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের প্রথম সাজা হয়। এরপর আরও চারটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে। বিদেশে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ গত ২ আগস্ট দুর্নীতির মামলায় তাঁর ৯ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই মামলায় তারেকের স্ত্রী জুবাইদা রহমানকেও তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মাত্র ১৬ কার্যদিবসে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁর বিরুদ্ধে ৫০টির অধিক রাজনৈতিক মামলা সচল; তাঁর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলার শুনানির দিন ধার্য থাকে। এসব মামলায় আগে এক-দুই মাস, তিন মাস পর শুনানির দিন ধার্য থাকত।
আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুটি মামলায় সাজা দেন ঢাকার আদালত। তাঁর আরও তিনটি মামলার বিচার চলছে।
আদালতেই কাটছে দিন
শতাধিক মামলার আসামি যেসব নেতা-কর্মী, আদালত অনেকটা তাঁদের ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। তাঁদের একজন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান। তাঁর মামলার সংখ্যা সাড়ে চার শর বেশি। তাঁর আইনজীবী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাবিব উন নবীর ৫০টিরও অধিক মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আদালতে না হাজির হলেই জামিন বাতিল হয়ে যাবে।
হাবিব উন নবী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্র ও শনিবার বাদে প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠেই চলে আসি আদালতে। কোনো দিন সকালে নাশতা করতে পারি, কোনো দিন আদালতে এসে নাশতা করি।’ তিনি বলেন, তিন মাস ধরে প্রতিদিনই সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আমি আদালতে অবস্থান করি। এক মামলায় মহানগর আদালতে থাকি, আরেক মামলায় আবার ঢাকার সিএমএম কোর্টে হাজির হতে হয়। আদালতই আমার ঠিকানা হয়ে গেছে।’
বিএনপির নেতারা যা বলছেন, তা সঠিক নয়। কয়েক বছরের পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করছে। বিএনপি নেতাদের কোনো মামলা নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ কাজ করছে না।এ এম আমিন উদ্দিন, অ্যাটর্নি জেনারেল
মামলার তথ্য এবং বিএনপির নেতাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এমন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁর বিরুদ্ধে ৫০টির অধিক রাজনৈতিক মামলা সচল; তাঁর প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলার শুনানির দিন ধার্য থাকে। এসব মামলায় আগে এক-দুই মাস, তিন মাস পর শুনানির দিন ধার্য থাকত। দুই মাসের বেশি সময় ধরে শুনানির দিন ধার্য হচ্ছে ৭ থেকে ১৫ দিন পরপর।
বিএনপির আইনজীবীদের আন্দাজ, ঢাকার আদালতে রোজ আসতে হয়, এমন নেতা-কর্মীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হবে।
মামলার শুনানির তিন মাসের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসেই আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে ৫৩টি মামলায় শুনানির দিন ধার্য ছিল। গড়ে দুটির বেশি মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল ঢাকার আদালতে।
তবে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছরের পর বছর যেসব মামলা ঝুলে আছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমরা আদালতে সাক্ষী হাজির করছি। বিএনপি নেতাদের মামলা নিষ্পত্তির কোনো টার্গেট রাষ্ট্রপক্ষের নেই।’
গত মাসে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে ৩৪টি মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয় বলে জানালেন তাঁর আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৫টি মামলায় বিচার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়েে।
মির্জা ফখরুল ইসলামের গত আগস্ট মাসে ঢাকার আদালতে ৭টি মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। তাঁর আইনজীবী মেজবাহ জানান, প্রতি মাসেই বেশ কয়েকবার বিএনপির মহাসচিবকে মামলায় হাজিরা দিতে হয়। বর্তমানে একটি মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। সর্বশেষ ৪ সেপ্টেম্বর পল্টন থানার মামলায় মির্জা ফখরুল, রুহুল কবির রিজভী, হাবিব উন নবী খানের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়।
মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, একইভাবে প্রায় প্রতি কর্মদিবসে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপির স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী (২৫০ মামলা), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম (২২৬ মামলা), যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহ উদ্দিন (৩১৫ মামলা), স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী (১৭০ মামলা), সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান (১৪৬ মামলা), জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল কাদির ভূঁইয়া (১৫০ মামলা), আকরামুল হাসান (১৪৬ মামলা), হাবিবুর রশীদ (১০৩ মামলা), বজলুল করিম চৌধুরী (৯৫ মামলা), মামুন হাসান (২০০ মামলা), সহসাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল (১১০ মামলা), গণশিক্ষাবিষয়ক সহবিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার (২১১ মামলা), ছাত্রদলের সাইফ মোহাম্মদ (১০৬ মামলা)।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যে বলে আসছে, ফৌজদারি মামলা দিয়ে তাদের লোকজনকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির সেই কথাগুলো এখন সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। বিএনপি নেতারা মামলায় হাজিরা দিয়ে চলেছেন; কারও কারও সাজা হচ্ছে। তিনি বলেন, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফল খুব খারাপ হয়।