সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আজ রোববার বিকেলে সারা দেশে সড়ক–মহাসড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা এই কর্মসূচির নাম দিয়েছেন ‘বাংলা ব্লকেড’। এর পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হবে।
দাবি আদায়ে গতকাল শনিবার পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শাহবাগ মোড় প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা বলছেন, কোটা বাতিলের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন না।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, রংপুর ও কুষ্টিয়ায় মহাসড়ক এবং ঢাকার তাঁতীবাজার মোড় ও খুলনায় সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা।
সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। গতকাল বেলা সোয়া তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল বের করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে পলাশী ও আজিমপুর এলাকায় যায়। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে শাহবাগ মোড়ে পৌঁছায়। এরপর বিকেল পৌনে পাঁচটা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।
বিক্ষোভে স্লোগান ছিল ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘তারুণ্যের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’। এ সময় রাস্তার এক পাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য অবস্থান করছিলেন। অবরোধের কারণে শাহবাগ মোড় দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। দুর্ভোগে পড়েন মানুষ।
অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সারা দেশে আগামীকাল (আজ) বেলা তিনটায় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করা হবে। ঢাকায় শাহবাগ মোড়, সায়েন্সল্যাব, চানখাঁরপুল, নীলক্ষেত, মতিঝিলসহ প্রতিটি পয়েন্টে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসবেন এবং এ কর্মসূচি সফল করবেন। ঢাকার বাইরের জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করবেন৷
কোটাবিরোধী আন্দোলনের এই সমন্বয়ক আরও বলেন, শিক্ষার্থী ও আদালতকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে সরকার দায়িত্বহীন আচরণ করছে। এখানে নির্বাহী বিভাগ তার দায় এড়াতে পারে না। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোটা থাকবে না। তাহলে কোটা কেন আবার ফিরে এল? কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন করা হচ্ছে? তিনি বলেন, ‘দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আমরা হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করব। এটা শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। শিক্ষক-অভিভাবকদেরও আন্দোলনে নেমে আসতে হবে।’
বিক্ষোভে স্লোগান ছিল ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘তারুণ্যের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’।
বাধা দেওয়ার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর ক্যানটিনে অবস্থান করেন ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও তখন মধুর ক্যানটিনে ছিলেন।
কোটা বাতিলের দাবিতে গতকালের মিছিলে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থীদের তৈরি করা ব্যানার ছাত্রলীগের এক নেতা ছিঁড়ে ফেলেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী। তবে ওই নেতার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগ বাধা দিচ্ছে বলে বিকেলে শাহবাগে অভিযোগ করেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করার সাংগঠনিক নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
এর আগে ১ জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর ক্যানটিনে অবস্থান করেন ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও তখন মধুর ক্যানটিনে ছিলেন।
রাজধানীর তাঁতীবাজারে বিক্ষোভ
কোটা বাতিলের দাবিতে গতকাল বেলা সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে বেলা তিনটায় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ঘুরে প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে তাঁতীবাজার মোড়ে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে। অবরোধের কারণে আশপাশের এলাকায় যানজট তৈরি হয়।
এই কর্মসূচিতে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।
সারা দেশে সড়ক অবরোধ–বিক্ষোভ
দাবি আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসংযোগ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তাঁরা। আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হলে যান এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসার আহ্বান করেন। পরে মিছিলটি শহীদ মিনারের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়।
গতকাল টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মহাসড়ক অবরোধ করেন। এই মহাসড়ক দিয়ে রংপুর, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের যানবাহন চলাচল করে। দেড় ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক থেকে সরে যান।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে এক ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মহাসড়কে অবস্থান করেন তাঁরা। এতে সেখানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
কোটা বাতিলের দাবিতে পদযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে নগরের মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি চলে।
বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও। গতকাল বেলা ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেও ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় ৩০ মিনিট অবরোধ শেষে মহাসড়ক থেকে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যান তাঁরা।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে এক ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মহাসড়কে অবস্থান করেন তাঁরা। এতে সেখানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দাবি আদায়ে তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন খুলনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ওই দাবিতে এবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন খুলনার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত শহরের শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থীরা শহরের টাউন হল মোড়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন।
গত ৫ জুন কোটার পরিপত্র বাতিলের রায়ের পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। এর মধ্যে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, ২০১৮ সালে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।
এর বাইরে কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে আগের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করতে হবে বলে দাবি করে আসছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা বলছেন, এই কমিশনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে। অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক ও ন্যূনতম কোটা রাখা যেতে পারে। তবে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে। চাকরিতে একই কোটা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গত ৫ জুন কোটার পরিপত্র বাতিলের রায়ের পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। এর মধ্যে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, ২০১৮ সালে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]