দেশের সব মা ভালো আছেন—এ কথা বলা যাচ্ছে না। অনেক মা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো নেই। বয়স্ক মায়েরা বেশি সমস্যায় আছেন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৭৩ লাখ। সব মা সুস্থ থাকলে বাংলাদেশ ভালো থাকবে। আন্তর্জাতিক মা দিবস উপলক্ষে আজ রোববার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেছেন।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) নিজস্ব মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মূলত মা হয়েছেন, এমন নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে অনুষ্ঠানে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে একাধিক মা নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
প্রথম উপস্থাপনায় নিপসমের মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান উমুল খায়ের আলম বলেন, বাংলাদেশের মায়েদের কিছু বাধার মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে আছে—আর্থসামাজিক দুর্ভোগ, বাল্যবিবাহ, অল্প সময়ে সন্তান ধারণ ও জন্মদান, মাতৃত্বজনিত জটিলতা, লিঙ্গবৈষম্য, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণে সেবার ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা। প্রজনন বয়সী নারীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ মাতৃমৃত্যু। বর্তমানে এক লাখ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
বয়স্ক মায়েদের সমস্যা বর্ণনা করার সময় উমুল খায়ের আলম বলেন, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারী আছেন ৭৩ লাখ। তাঁদের মধ্যে অনেকই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নন। তাঁদের অনেকেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেঁচে আছেন; অনেকে দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন। ২০২১ সালের একটি ছোট গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বয়স্ক নারীদের ৮০ শতাংশ শারীরিকভাবে দুর্বল, ৭১ শতাংশের হজমের সমস্যা থাকে, ৫৭ শতাংশ শরীরে ব্যথার কথা বলেন।
আজীবন মানসিক চাপ
সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের জন্য আনন্দের ঘটনা। মা এর জন্য গর্ববোধ করেন। মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন নারীর জীবন পুরোপুরি বদলে যায় বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। এই মনোরোগ চিকিৎসক বলেন, সন্তান জন্মদানের পর থেকে অনেক মায়ের মধ্যে সন্তানের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া, রাস্তাঘাটের বিপদ, সন্তানের বিপথে যাওয়া না যাওয়া, নেশাগ্রস্ত হওয়া—এসব নিয়ে মায়ের ভয় ও দুশ্চিন্তা হতে থাকে। সন্তান কোনো ভুল করলে মা অপরাধবোধ বা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। মা ভাবেন, ‘আমি ভালো মা না। আমার কারণে সন্তানের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। আমি কিছুই ঠিকমতো পারি না।’
মেখলা সরকার বলেন, এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা পারিবারিক ও সামাজিক চাপ। এসব চাপের কারণে অনেক মা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। মায়েদের উদ্বেগ দেখা দেয়—এই মায়েরা ভয়ে থাকেন, তাঁদের মেজাজ খিটখিটে হয় এবং তাঁরা অস্থির ও দুশ্চিন্তায় থাকেন। অনেক মা বিষণ্নতায় ভোগেন—তাঁদের মনখারাপ থাকে, কোনো কিছুতেই আগ্রহ থাকে না এবং সব সময় নেতিবাচক চিন্তায় মগ্ন থাকেন।
মানসিক সমস্যার কারণে মায়েদের কিছু শারীরিক সমস্যার বর্ণনা করেন মেখলা সরকার। এরপর তিনি বলেন, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছয়টি—একা মা, সামর্থ্যহীন মা, অন্যের ওপর নির্ভরশীল, বন্ধুহীন মা, নিয়ন্ত্রণকামী মা ও অতি স্নেহপ্রবণ মা।
মায়ের পাশে কে দাঁড়াবে
মা সুস্থ থাকবেন কীভাবে, সে বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন নিপসমের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. জিয়াউল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রত্যেক মাকে টিটিনাস ও এইচপিভি টিকার আওতায় আনতে হবে। তাঁদের রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার পরীক্ষা করতে হবে। সন্তান জন্মদানের পরপরই বুকের দুধ খাওয়ানো ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করতে হবে। তাঁদের প্রসবপূর্ব ও প্রসব–পরবর্তী সেবা দিতে হবে; বয়স্ক মায়েদের পুষ্টি ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং যাঁর প্রয়োজন, তাঁকে পুনর্বাসন সেবা দিতে হবে।
বেশ কয়েকজন মা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। এর মধ্যে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা বেগম বলেন, পরিবারে স্ত্রী (মা) যদি স্বামীর (বাবা) অবহেলার শিকার হন, তাহলে সন্তান বড় হয়ে মায়ের প্রতি বাবার মতোই আচরণ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের শ্রমঘণ্টা কোনো কিছুর বিনিময়ে পরিশোধ করা সম্ভব নয়।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ একসময় ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন। তখনকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সময় এই চিকিৎসক বলেন, অস্ত্রোপচারের জন্য শিশুদের কিছু সময়ের জন্য মায়ের কোল থেকে নেওয়া হয়। মায়েরা বুক ফাটা কান্না শুরু করেন। অঝোরে ঝরতে থাকে চোখের পানি। তিনি আরও বলেন, ‘মায়েদের জন্য যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানি দেওয়া হয়, তাহলে তাঁদের মর্যাদা বাড়ার সম্ভাবনা আছে।’
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে চিকিৎসকেরা একটি নাটক মঞ্চায়ন করেন। এতে দেখা যায়, অসুখে মায়ের উপস্থিতি জাদুর মতো কাজ করে, ওষুধের মতো কাজ করে। বলা হয়, মা যেন মেডিসিন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নিপসমের পরিচালক অধ্যাপক মো. সামিউল ইসলাম। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফাতেমা রহমান।