বাংলাদেশি শকুনের ভারতভ্রমণ
সন্ধ্যার আগে আগে হঠাৎই খবর পেলাম, খুলনার খালিশপুরে একটি শকুন ধরা পড়েছে। এটি বেশ দুর্বল। বয়স বছর পাঁচেক হবে। খুলনার বন অধিদপ্তরের সহকর্মীরা শকুনটিকে নিয়ে গেলেন তাঁদের পরিচর্যাকেন্দ্রে। দিনটি ছিল এ বছরের ২৭ এপ্রিল। পরিচর্যা শেষে পাখিটি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠল।
গত ১৫ মে গবেষণার জন্য শকুনটির গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দিলাম আমরা। মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশে এর গতিবিধি দেখা এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকে কি না, তা দেখাই এ গবেষণার উদ্দেশ্য। ১০ জুন সুন্দরবনের অদূরে দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামে শকুনটিকে মুক্ত করে দিলাম। মুক্ত আকাশে এটি উড়ে গেল। তারপর বেশ কিছুদিন এই পাখি আশপাশের এলাকায় ঘুরে ঘুরে খাচ্ছিল। আমি তার গতিবিধি দেখি আর উৎফুল্ল হই।
গত ২৫ জুলাই শকুনটি তার গতিবিধি পাল্টাল। যাত্রা শুরু করল সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে। ভারতের এক পাখি–গবেষক বন্ধু মালেয়াশ্রী ভট্টাচার্যকে ফোন করে বললাম, আমাদের শকুনটি এখন তাঁর দেশের কল্যাণী, রানাঘাট ও শান্তিপুর এলাকায় অবস্থান করছে। পরদিন তিনি বললেন, শকুনটি একনজর দেখার জন্য যাবেন। আমি তাঁর সঙ্গে শকুনটির গতিবিধি দেখার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু সেই কল্পনা আসলে ভেস্তে গেল। শকুনটি আরও পশ্চিমের দিকে যেতে শুরু করেছে। শেষমেশ এটি ঝাড়খন্ড রাজ্য প্রায় পার হয়ে যেতে লাগল। একটি বাংলা শকুনের এভাবে ভ্রমণ পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল ঘটনা।
বাংলা শকুন মূলত এ দেশের আবাসিক পাখি। এ দেশে এরা ডিম পেড়ে বাচ্চা দেয়। আমাদের দেশে এখন ২৫০টির মতো এ জাতের শকুন টিকে আছে। দেশে-বিদেশে শকুন নিয়ে আমি গবেষণা করছি এক যুগের বেশি সময় ধরে। কিন্তু একটি আবাসিক শকুনের এ ধরনের ঘটনা সবাইকেই অবাক করেছে। বাংলা শকুন মূলত ১০০ কিলোমিটার রেডিয়াসে ঘুরে প্রায় ৩২ হাজার বর্গমাইল পর্যন্ত খাবার খোঁজে। কিন্তু এই শকুন তা থেকে অনেক গুণ বেশি ভ্রমণ করেছে।
শকুনটি বাংলাদেশ সীমানা থেকে প্রায় ১ হাজার ২১৪ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ড রাজ্যের হাজারীবাগ এলাকার বিষ্ণুঘাদ পর্যন্ত গেল। সেখানকার কনার ড্যাম লেক এলাকায় শকুনটি ঘোরাঘুরি করছিল। এই এলাকায় শকুনের দুটি বড় কলোনি আছে বলে ভারতের পাখি–গবেষকেরা আমাকে জানিয়েছেন। ১১ আগস্ট হঠাৎ এক ভারতীয় পাখিবন্ধু ফোন করলেন। একটি ট্যাগযুক্ত শকুন পাওয়া গেছে। শকুনটির প্রায় আধমরা অবস্থা। ছবি দেখে তাঁদের সবাইকে আশ্বস্ত করলাম, এটি আমাদের বাংলাদেশের শকুন। সেখানকার বন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। ফোন করলেন সেখানকার গবেষক বন্ধু সত্য প্রকাশ। তাঁদের সবার সহযোগিতায় পাখিটিকে নেওয়া হলো স্থানীয় রাঁচি চিড়িয়াখানায়।
শকুনটি ভারতীয়দের কাছে সুস্থ হয়ে উঠবে বলে সবাই বলছে। বাংলাদেশে শকুনটি ছাড়ার পর মুক্ত আকাশে ৪৫ দিন উড়েছে। তারপর আবার মাটিতে পড়ে গেছে। ভারতে ক্ষতিকর ওষুধ ডাইক্লোফেনাকসহ অন্যান্য ওষুধের প্রয়োগ হয় পশুর চিকিৎসায়। আর চিকিৎসার পর এ রকম মরা পশু শকুন খেলে বিষক্রিয়ায় দ্রুতই মারা পড়ে। আমরা সঠিক জানি না এই শকুনের ক্ষেত্রে কোন ক্ষতিকর ওষুধের প্রভাবে এ অবস্থা হয়েছে। পাখিটির শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। আশা করি, পাখিটি অসুস্থ হওয়ার কারণ উদ্ঘাটিত হবে।
শুনেছি, শকুনটি নিয়ে ভারতে স্থানীয় পর্যায়ে একটি গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও খবরের কাগজে। শকুনের শরীরে স্যাটেলাইট যন্ত্র পরানো নিয়ে স্থানীয় পুলিশসহ প্রশাসনকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে সেখানকার গবেষকদের। পাখিটির এই অসাধারণ ভ্রমণে তাঁরা সবাই আশ্চর্য হয়েছেন। ভারতের বন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এই শকুনটির এখন পরিচর্যা করা হচ্ছে। আশা করি, শকুনটি দ্রুতই সুস্থ হয়ে আবার আকাশে উড়ে ফিরে আসবে আমাদের সুন্দরবনে।
গোটা পৃথিবী থেকে বাংলা শকুনের প্রায় ৯৯ শতাংশ হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট কিছু শকুন এখন কোনোরকমে টিকে আছে। সম্প্রতি একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র বের হয়েছে ভারতের প্রেক্ষাপটে। সেখানে বলা হচ্ছে, ডাইক্লোফেনাকের প্রভাবে শকুনের হারিয়ে যাওয়ার ফলে পাঁচ লাখের বেশি মানুষের কোনো না কোনো কারণে মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীতে শকুনই একমাত্র পাখি, যা সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃতির ঝাড়ুদার আমার সবচেয়ে প্রিয় পাখি এই শকুন আবার বাংলার আকাশে ফিরে আসুক, এ কামনা করি।