শাপলা ফোটা নয়নাভিরাম আড়িয়ল বিল
তুলসীখালী সেতুর ওপর থেকে দুই পাশে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সেতুটি সমতল থেকে বেশ উঁচু। ধনুকের মতো বাঁকা। তলা দিয়ে তরঙ্গ তুলে বয়ে যাচ্ছে ধলেশ্বরী। সবে বর্ষা পেরিয়েছে। নদীর ভরা যৌবনে ভাটার টান পড়তে স্রোতের মতো ঢের সময়ও পেরিয়ে যাবে। বড় বড় বার্জ আর বালুভরা বাল্কহেড ভেসে যাচ্ছে ঘোলা পানিতে প্রপেলারের ঘূর্ণি তুলে। মাঝেমধ্যে ছোট–বড় দু-একটি নৌকাও দেখা যায়। তবে নদীর সৌন্দর্য ছাপিয়ে যায় সামনের দিকে তাকালে। ডানে-বাঁয়ে অগণিত শাপলার পসরা মেলে নয়নাভিরাম হয়ে আছে আড়িয়ল বিল।
কেরানীগঞ্জ থেকে দুই লেনের পিচঢালা পথ চলে গেছে নবাবগঞ্জের দিকে। অল্প কিছুকাল আগে সড়কটি সংস্কার করায় এখনো যথেষ্ট মসৃণ। কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর বাজারের মোড়ের পর থেকেই পথে যানবাহনের সংখ্যা কম। সিএনজিচালিত স্কুটার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাই এই পথের প্রধান গণবাহন। আর চলে মোটরসাইকেল। গুলিস্তান থেকে দোহার-নবাবগঞ্জের নবকলি পরিবহনের বাস ছাড়ে। তবে সংখ্যায় কম। তাই রোহিতপুর থেকে নবাবগঞ্জের টিকরপুর পর্যন্ত দীর্ঘ পথটি যানজটমুক্তই থাকে।
কয়েক দিন ধরে প্রায়ই এই পথে নবাবগঞ্জ-দোহারে যাতায়াত করছি। মাথার ওপর শরতের উদার আকাশ। নীল পটভূমিতে নানা আকারের সাদা মেঘের স্তূপ ছড়িয়ে থাকে। ভেসে যায়। খররোদে ঝলমল করে চরাচর। তুলসীখালী থেকে খারশুর সেতু পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক চলে গেছে আড়িয়ল বিলের ভেতর দিয়ে। মাঝখানে আরও একটি বড় সেতু আছে। সেটি মহাকবি কায়কোবাদ সেতু। মহাকবির বাড়ি এ এলাকাতেই।
আড়িয়ল বিলটি আসলে পড়ছে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। দেশের মধ্যাঞ্চলের এটিই সবচেয়ে বড় বিল। আয়তন প্রায় ২৬০ বর্গমাইল। জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মধ্যবর্তী বিশালাকার এ বিলের প্রভাব পড়েছে পাশের নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলাতেও। এ দুই উপজেলারও অধিকাংশ এলাকা নিচু; বর্ষা ও শরতে জলমগ্ন থাকে। আড়িয়ল বিলের একটি অংশ পড়েছে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায়। নবাবগঞ্জ যাওয়ার সড়কটি বিলের অংশটির ভেতর দিয়েই চলে গেছে।
বড়ই চোখজুড়ানো দৃশ্য এখন আড়িয়ল বিলে। সড়কের দুই পাশে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা জলাভূমি ছেয়ে আছে গোল গোল শাপলাপাতা, কলমিলতা, কচুরিপানাসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদে। কোথাও কোথাও ধঞ্চেখেত ঘন ঝোপের মতো দেখায়। দূরে দূরে দু-একটা হিজলগাছ। এর মাঝে মাঝে রোদের কিরণে ঝিকমিক করে ওঠে বিলের শান্ত স্বচ্ছ সলিল। বাঁশের খুঁটির ওপর বসে থাকা পানকৌড়িগুলো হঠাৎ ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে ঝপাৎ করে ঝাঁপ দেয় মাছের আশায়। শাপলাপাতার ওপর সাবধানী পা ফেলে এগিয়ে যায় বকেরা। আর ফড়িংয়ের পিছু তাড়া করে বিলের ওপর চক্কর কেটে বিদ্যুতের তারের ওপর বসে লেজ নাচায় কালো ফিঙেগুলো। এখন শরতের অনন্য উপহার শাপলা ফোটার পর্ব শুরু হয়েছে। ফোটা-আধফোটা হাজারো শাপলায় আড়িয়ল বিল যে কী রকম সুশোভিত হয়ে আছে, তার বর্ণনা দেওয়া অসাধ্য।
পথটিও মনোরম। দুই পাশ দিয়ে বুনো লতাগুল্মের ঝোপঝাড়ের বাড়বাড়ন্ত। তাতে হলুদ, বেগুনি, গোলাপি—নানা রঙের নাম না–জানা ফুল ফুটে আছে। তেলাকুচো সাদা ফুলগুলো একটু বড় আকারের। শক্ত কাণ্ডের গুল্মের ওপর বিছিয়ে আছে তেলাকুচোর লতা, আর তার ওপর সাদা ফুল ফুটেছে ডজন ডজন। গাছগাছালিতে বেশ বৈচিত্র্যও আছে। তুলসীখালীর খানিকটা পরে দুই পাশে সারিবদ্ধ তালগাছ, আবার আরও খানিকটা সামনের কলাগাছের সারি, তারপর আবার লতাগুল্মের সমাহার—এভাবেই গেছে প্রায় টিকরপুর পর্যন্ত। খররোদে বিলের পানির বাষ্প, বুনোফুলের সৌরভ, ভেজা মাটির গন্ধ—সবটা মিলিয়ে অন্য রকম এক ভেষজ ঘ্রাণ উঠে আসে পুরো জলজ প্রকৃতি থেকে।
বর্ষা বিদায় নিলেও বৃষ্টি একেবারে যায়নি। ফলে গাছগাছালি, লতাপাতা সব ধুলাবালুমুক্ত। পরিষ্কার প্রাণবন্ত সবুজে সুস্নিগ্ধ। কোথাও মলিনতা, শুষ্কতার চিহ্ন নেই। প্রাণপ্রাচুর্যের এই বিপুল বৈভব মনের মলিনতাও ঘুচিয়ে দেয়, প্রস্ফুটিত ফুলের মতোই প্রফুল্ল করে তোলে।
বেলা গড়ালে দৃশ্যপট অন্য রকম। পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের রক্তিম আভায় সাদা মেঘগুলো তখন হয়ে ওঠে আবিররাঙা। ধীরে ধীরে দিগন্ত থেকে নেমে আসে আবছায়া। বড় সেতুগুলোয় তখন আশপাশের অনেক লোক এসে জড়ো হন সেই দৃশ্য উপভোগ করতে। অনেকে দূর থেকেও বেড়াতে আসেন। পথচলতি বাইকারদের কেউ কেউ থামেন ক্ষণকালের জন্য। বেলা শেষের রোদ বুকে নিয়ে ধলেশ্বরীর স্রোত ছুটে যায় স্বর্ণালি প্রভায়।
আড়িয়ল বিলের সৌন্দর্য যেমন নয়নাভিরাম, তেমনি উন্নয়নকামীদের দৃষ্টিতেও তার অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বিলের ১৫ হাজার একর জায়গাজুড়ে। ২০১১ সালে জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শুরু হয়েছিল। পরে আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির প্রবল প্রতিবাদ জানায়। বিল রক্ষাকারীদের বক্তব্য ছিল, বিলের জমিতে বছরে প্রতি একরে প্রায় ১০০ মণ ধান হয়। এ ছাড়া প্রচুর রবিশস্য হয়, পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণে মাছ ও শামুক। চাষাবাদ আর এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে এলাকার বিপুল সংখ্যার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। বিলটি না থাকলে তাঁরা জীবিকাহীন হয়ে পড়বেন। তাঁদের প্রয়োজন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। সে কারণে প্রতিবাদটিও হয়েছিল প্রবল। মনে পড়ে, ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি সেই প্রতিবাদ–মানববন্ধনে পুলিশের সঙ্গে জনতার তুমুল মারপিট হয়। তাতে একজন পুলিশ তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অনেক মানুষ। তাতে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দরের প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
বিমানবন্দর না হলেই আড়িয়ল বিল রক্ষা পাবে—এমন নিশ্চয়তা কি আছে? তুলসীখালী সেতুর পরেই বিল ভরাট করে ৩১০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক গড়ে তোলার কাজ চলছে। এরপর আরও হবে মুদ্রণ শিল্পনগরী, প্লাস্টিক শিল্পপার্ক, বিসিক শিল্পনগর, ওষুধশিল্প, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের শিল্প—এমন অনেক শিল্পনগর। বিমানবন্দরের বিশাল থাবা গুটিয়ে গেলেও শিল্পনগরের চিমটি চিমটি পরিমাণে একটু একটু করে একসময় আড়িয়ল বিলের সজল প্রকৃতি যে দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে, তা নিশ্চিত। শাপলা ফোটা বিলে গড়ে উঠবে অজস্র দরদালান, হিজলতরুর জায়গায় মাথা তুলবে কারখানার চিমনি, সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
উন্নয়নের বিস্তার আর প্রকৃতি বিনাশের দ্বৈরথ সভ্যতার সূচনা থেকেই চলছে। এ এক নিষ্ঠুর ধ্রুপদি বিষয়। উন্নয়নের মহান অজুহাতে কত কত নিসর্গের হলো বলিদান এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে, সে কথা কি লেখা থাকবে অশ্রু দিয়ে—কার সে অশ্রু?