জাল সনদ তৈরিতে ৬০ হাজার টাকা, ভাতা চালু করতে আরও ৬০ হাজার

বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে একজন উপসচিব এ বিষয়ে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন

.

একসময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজশাহীর বাঘা থানা ইউনিটের সহকারী কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছেন। এসব সনদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ চৌধুরীর স্বাক্ষর জাল করেছেন তিনি। 

আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ-সংক্রান্ত ৪টি মামলার তদন্ত শেষে গত মার্চে পিবিআই আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে। সব মামলাতেই অভিযুক্ত করা হয়েছে আনোয়ার হোসেনকে। 

গত মার্চে পিবিআইয়ের রাজশাহী অঞ্চল থেকে সদর দপ্তরে (পিবিআই সদর দপ্তর) পাঠানো এক প্রতিবেদনে তদন্তের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের পুনরায় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থ দিয়ে সনদ নেওয়া ব্যক্তিরা প্রতারণার অভিযোগ এনে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। মামলাগুলো করা হয়েছে ২০২১ ও ২০২২ সালে। যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, বোয়ালিয়া ও পুঠিয়া অঞ্চলে। 

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজশাহীর বাঘা থানা ইউনিটের সহকারী কমান্ডার আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে 

পিবিআই যে চারটি মামলা তদন্ত করেছে, এর মধ্যে তিনটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী জেলা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) গৌতম চক্রবর্তী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁদের বলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। টাকার বিনিময়ে তাঁরা যে সনদ পেয়েছিলেন, সেগুলো ভুয়া ছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে আনোয়ার হোসেনকে টাকা ফেরত দিতে বলেন তাঁরা। টাকা ফেরত না দেওয়ায় প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন আদালতে মামলা করেন। 

এসআই গৌতম চক্রবর্তী তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২০১৩ সালের পর স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত
হয়। তাঁরা কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়েছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা প্রকাশ করা হলে সেখানে তাঁদের নাম পাওয়া যায়নি। এতে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে জানতে পারেন তাঁরা। ভাতা বন্ধ হওয়ার পর আনোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জানান। আনোয়ার হোসেন তাঁদের বলেন, এই ভাতা চালু করার জন্য সনদ তৈরি করতে হবে। সনদ তৈরিতে ৬০ হাজার এবং ভাতা চালু করতে ৬০ হাজার করে টাকা লাগবে। এভাবে আনোয়ার হোসেন তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে সনদ প্রদান করেন। তবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁরা ভাতা না পেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁদের যে সনদ দেওয়া হয়েছে, সেটি ভুয়া। 

যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁদের বলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। টাকার বিনিময়ে তাঁরা যে সনদ পেয়েছিলেন, সেগুলো ভুয়া ছিল।
গৌতম চক্রবর্তী, উপপরিদর্শক, পিবিআই

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজশাহীর বাঘা থানা ইউনিটের সহকারী কমান্ডার আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি টাকা নিয়ে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেননি। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও তদন্ত করে এসব অভিযোগের সত্যতা পায়নি। পিবিআইয়ের তদন্তের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আনোয়ার হোসেন বলেন, এসব অভিযোগ ঠিক নয়। তারা (পিবিআই) সঠিক তদন্ত করেনি। 

আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা ব্যক্তিদের একজন বাঘা উপজেলার আয়নাল শেখ। তাঁর ভাষ্য, তিনি ১৯৭১ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার কড়ইগাছি ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেন। তিনি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১৩ সালে তিনি সব নথিপত্রসহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভাতা পাওয়া শুরু করেন।

কিছুদিন পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে সনদ প্রাপ্তি এবং ভাতা প্রাপ্তির জন্য ২০১৭ সালে আনোয়ার হোসেনকে তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে প্রতারিত হন। 

পিবিআইয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে একজন উপসচিব এ বিষয়ে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। 

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বাক্ষর জাল করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে এ ধরনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।