শিক্ষাক্রম ওলট–পালট, বছরজুড়ে নানা অস্থিরতা

নবম শ্রেণির একটি ক্লাসরুমে পাঠদান চলছেপ্রথম আলো ফাইল ছবি

মাধ্যমিকে শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ তুলে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওলট–পালট হয় শিক্ষাক্রমও। পুরোনো শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে বিভাগ বিভাজন ফিরে আসছে ১ জানুয়ারি থেকে।

শুধু শিক্ষাক্রম নয়, এ বছরে শিক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা নানা কারণে পরিবর্তন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে এইচএসসির কয়েকটি পরীক্ষা বাতিল ও বিশেষ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন, পাঠ্যবই–সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি গঠনের পর তা বাতিল, সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়ে’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে পরে তা আন্দোলনের মুখে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে বছরজুড়ে শিক্ষায় নানা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বদল, সিদ্ধান্তহীনতা আর অস্থিরতা ছিল।

২০২৪ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সে রকম প্রতিফলন এখনো শিক্ষা খাতে আসেনি বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন হয়েছে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও কমিশন করা দরকার।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে অধ্যাপক মনজুর আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি হলেও এর ওপরের স্তরের জন্য এমন কোনো কমিটি হয়নি। ফলে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা খাতটি যেন অনেকটা সরকারের অগ্রাধিকারের বাইরে থাকছে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় বিভাগ বিভাজন করা হচ্ছে। পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

আলোচনায় শিক্ষাক্রম

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছিল। তার ধারাবাহিকতায় এ বছরের শুরুতে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও তা শুরু হয়। আগামী বছর ১ জানুয়ারি থেকে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে তা চালুর কথা ছিল। এর মধ্যে বড় পরিবর্তন হিসেবে নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেওয়া হয়।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় বিভাগ বিভাজন করা হচ্ছে। পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

সব শিক্ষার্থী সব বই পাবে না

করোনাকাল ছাড়া ২০১০ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়ার বিষয়টি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এ বছরের প্রথম দিনে সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোতে নতুন বই বিতরণ শুরু হলেও সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি। কারণ, বছরের প্রথম দিন পর্যন্ত অষ্টম ও নবম শ্রেণির প্রায় আড়াই কোটি বই ছাপানো শেষ হয়নি তখন।

আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনও সব শিক্ষার্থী সব বই পাচ্ছে না। এবার প্রাক্-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ৩১ কোটির মতো।

এনসিটিবির সূত্রমতে, প্রাথমিকের বই ছাপায় অগ্রগতি থাকলেও মাধ্যমিক অনেক পিছিয়ে। ফলে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা দু-তিনটি করে বই পেতে পারে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতেও বড় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিদ্যমান বেশ কিছু গল্প-কবিতা বাদ যাচ্ছে। ইতিহাসবিষয়ক বিষয়বস্তুতেও কাটছাঁট হচ্ছে। নতুন করে যুক্ত হচ্ছে জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের ওপর লেখা প্রবন্ধ ও কবিতা। অভ্যুত্থানের গ্রাফিতিও যুক্ত হচ্ছে।

এনসিটিবির সূত্রমতে, প্রাথমিকের বই ছাপায় অগ্রগতি থাকলেও মাধ্যমিক অনেক পিছিয়ে। ফলে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা দু-তিনটি করে বই পেতে পারে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

আন্দোলনে অস্থিরতা

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি নিয়ে প্রজ্ঞাপন বাতিল করাসহ তিন দফা দাবিতে এ বছরের ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন। এ কারণে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনিক ভবনেও কোনো কাজ হয়নি।

শিক্ষকদের এই দাবির বিষয়টি সরকার প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৩ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যয় স্কিমসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা সচল করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি। বাকি ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব কটি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেন। এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পরে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উপাচার্য দেয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে প্রায় তিন মাস লেগে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরেছে।

এইচএসসি পরীক্ষার ওপর ‘ঝড়’

এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল সাড়ে ১৪ লাখের মতো। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি পরীক্ষা বাকি ছিল। ব্যবহারিক পরীক্ষাও হয়নি।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিদ্ধান্ত হয় ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে। যদিও সেটা হয়নি। পরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর আগে ২০ আগস্ট একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করেন। তাঁদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয় শিক্ষা বিভাগ। আবার ফল প্রকাশের পরেও একদল শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। নতুন করে ফল প্রকাশের দাবিতে তাঁরা সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকেও বিক্ষোভ করেন। অবশ্য সেই দাবি আর পূরণ হয়নি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো বিদায়ী বছরটা শিক্ষা খাতে একটু অবহেলা করা হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কমিশনও হলো না।

গুচ্ছ ভর্তি

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি এবং খরচ কমাতে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছিল গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে তা শুরু হয়। প্রথমে হয় কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। সর্বশেষ দেশের ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।

এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি-ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী একটি পরীক্ষা দিয়েই তাঁর যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী গুচ্ছে থাকা যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন। কিন্তু এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছপদ্ধতি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদাভাবে ভর্তির কার্যক্রম শুরু করেছে। আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

অবশ্য এ রকম পরিস্থিতিতে ২৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম বহাল রাখতে গুচ্ছভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বছরটি কেমন গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো বিদায়ী বছরটা শিক্ষা খাতে একটু অবহেলা করা হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কমিশনও হলো না। আগামী বছরটি শিক্ষার জন্য অনুকূল থাকবে কি না, তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনিশ্চয়তা দেখছেন তিনি। তবে তাঁর আশা, আগামী বছর শিক্ষা কমিশন হবে এবং তার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য বছরটি ভালো যাবে।