ওড়ার গল্প: ডানা থেকে বেলুনে
ডিডেলাস ছিলেন দারুণ দক্ষ এক প্রকৌশলী। মিনোটর নামের দানবকে বন্দি করতে তাকে দিয়ে একটা গোলকধাঁধা বানিয়েছিলেন রাজা মাইনস। পরে বিপাকে পড়ে এথেন্সের বীর থিসিউসকে গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর পথ বাতলে দেন ডিডেলাস। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে ডিডেলাস এবং তার একমাত্র পুত্র ইকারুসকে একটা পাহাড়চুড়ায় বন্দী করে রাখেন। ডিডেলাস ঠিক করলেন আকাশপথে পালাবেন। পাখির পালক, মোম ও সুতা দিয়ে দুই জোড়া ডানা বানালেন তিনি। চামড়ার বেল্ট দিয়ে হাতের সঙ্গে ডানাগুলো বেঁধে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিলেন। ওড়ার আগে ছেলেকে পই পই করে নিষেধ করে দিলেন যেন উড়তে উড়তে খুব বেশি উঁচুতে চলে না যায়। ওড়ার আনন্দে মশগুল ইকারুস বাবার সাবধানবানী ভুলে সূর্যের খুব কাছে চলে গেল। তাপে তার ডানার মোম গলে গেল। ডানা থেকে খসে পড়ল পালক। সাগরে পড়ে মারা গেল ইকারুস।
গ্রিসের এই পুরাকাহিনী কমবেশি সবারই জানা। শুধু গ্রিকই নয়, সারা দুনিয়ার পুরাণেই মানুষের আকাশে ওড়া নিয়ে গল্প পাওয়া যায়। ভারতীয় পুরাণ এ বিষয়ে পিছিয়ে আছে, এমনটা ভাবারও সুযোগ নেই। ইগলের মতো মুখ ও ডানাসংবলিত গরুড় হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন। স্বর্গমর্ত্য সর্বত্র গরুড় নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিষ্ণু। রামায়ণে বিমানের উল্লেখ আছে। এই বিমানকে অবশ্য আজকের যুগের উড়োজাহাজ ভাবলে ভুল করা হবে। এ হচ্ছে ভারতীয় পুরাণের উড়ুক্কু যান, যাতে চেপে দেবদেবীরা আকাশপথে যাতায়াত করতেন। এসব বৃত্তান্ত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই পাখির মতো আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে মানুষ এবং নানা কল্পনায় তার ইচ্ছার ছবি এঁকেছে।
ডানা পর্ব
মানুষের আকাশে ওড়ার বাস্তব বা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচেষ্টার প্রথম খবরও আমরা গ্রিস থেকেই পাই। অবশ্য নিজে না, পাখির মতো একটি মডেলকে খানিকটা পথ ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল মানুষ। গ্রিক ঐতিহাসিক অলাস গিলিয়াস জানাচ্ছেন, কাঠের পাখিটিকে প্রায় ২০০ মিটার ছুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন আর্কিটাস। যিশুর জন্মেরও ৪০০ বছর আগে কাণ্ডটা করেছিলেন এই গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ।
পাখির মতো ডানা তৈরি করে দুই হাতে বেঁধে উঁচু মিনার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা চীনা ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়। প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকে চীনা সম্রাট ওয়াং মংয়ের নির্দেশে একজন স্কাউট কৃত্রিম ডানায় ভর করে প্রায় ১০০ মিটার উড়েছিলেন। ৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধবন্দী উয়ান হুয়াংতোকে নকল ডানায় ভর করে একটি মিনার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। হুয়াংতো অবশ্য নিরাপদেই মাটিতে নেমে আসতে পেরেছিলেন।
তবে কার্যকরভাবে উড়তে সক্ষম, এমন যান্ত্রিক ডানা বা গ্লাইডার তৈরিতে প্রথম সফল হয়েছিলেন সম্ভবত আব্বাস ইবনে ফিরনাস। কর্দোভার এই মানুষটি ছিলেন একাধারে কবি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, সংগীতশিল্পী ও প্রকৌশলী। ৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে কাঠের হালকা কাঠামোয় কাপড় জড়িয়ে ডানা তৈরি করেন ফিরনাস, তারপর সেটা নিয়ে কর্দোভার গ্রেট মসজিদের মিনার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আকাশে ভাসমান অবস্থায় ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসার সময় সামান্য আঘাত পান। নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতে আরও কয়েকবার আকাশে উড়েছিলেন ফিরনাস। এভাবে তাঁর ডানার আরও উন্নতি সাধন করেন। পরে একদিন কর্দোভার শহরতলি রুসাফাতে ডানা নিয়ে পাহাড়ে উঠলেন তিনি। তাঁর ওড়া দেখতে জড়ো হলো আশপাশের এলাকাবাসী। রেশম আর ইগলের পালকে তৈরি ডানা নিজের দেহ ও দুই হাতের সঙ্গে জুড়ে পাহাড়ের উঁচু থেকে ঝাঁপ দিলেন। ডানায় ভর করে আকাশে বেশ উঁচুতে ১০ মিনিটের মতো ওড়াউড়ি করলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আকাশে পাখির মতো উড়ছিলেন তিনি। যেখান থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, উড়ে আবার সেখানেই ফিরে আসেন। এবারও মাটিতে নেমে আসার সময় শরীরের পেছন দিকে আঘাত পান। পাখি মাটিতে নেমে আসার সময় লেজ দিয়ে যেভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করে, পোশাকে তেমন ব্যবস্থা না থাকাতেই এই বিপত্তি। এ আঘাতের কারণে পরে তিনি ওড়াউড়ি থেকে সরে আসেন। ৮৮৭ সালে মারা যান আব্বাস ইবনে ফিরনাস। তাঁর কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি আজ আর পাওয়া যায় না। ফিরনাসের এই চেষ্টার পরের কয়েক শ বছর আকাশে ওড়ার তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
১০০২ সালে তুর্কির এক শিক্ষক আল-জুহারি কৃত্রিম ডানায় ভর করে উলু মসজিদের মিনার থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে মারা যান। ১০১০ সালে এইলমার নামে এক ইংলিশ যাজক মেলসসবারি অ্যাবের টাওয়ার থেকে ঝাঁপ দিয়ে কৃত্রিম ডানায় প্রায় ৬০০ ফুট অতিক্রম করেন। তবে তাঁর দুটো পা–ই ভেঙে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন পরে ১৫০০ সালের দিকে বিখ্যাত শিল্পী ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আকাশে ওড়ার উপযোগী বেশ কিছু যন্ত্রের ছবি এঁকেছিলেন; তবে বাস্তবে সেগুলো বানিয়ে ওড়ার চেষ্টা করেননি।
১৬৩৮ সালে তুর্কির হেজারফেন আহমেদ সেলেবি ইস্তাম্বুল শহরে বসফোরাসের কাছে গালান্টা টাওয়ার থেকে ডানার সাহায্যে আকাশে উড়েছিলেন। গ্লাইড করে প্রণালির অন্য পারে নিরাপদেই অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আল-জুহারির ভুলগুলো তিনি সংশোধন করতে পেরেছিলেন। হেজারফেনের আরেক ভাই লেগারি হাসান সেলেবিও বিজ্ঞানী ছিলেন। ১৬৩৩ সালে তুর্কির চতুর্থ সুলতান মুরাদের কন্যার জন্ম উপলক্ষে তিনি সাত ডানার একটি রকেট নির্মাণ করেন। সাতটি চোঙায় প্রায় ১৪০ পাউন্ড বারুদ ভরে দেওয়া হয়েছিল। এই রকেটটি পিঠে বেঁধে তিনি সমুদ্রের তীর থেকে সোজা আকাশে উড়ে আবার সমুদ্রে অবরতণ করেন।
পাখির অনুকরণে নকল ডানা তৈরি করে হাজার বছর ধরে এভাবে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছে মানুষ। পরে মানুষ বুঝতে পারে, পাখির মতো ডানা ঝাপটে আকাশে উড়া তার কম্ম নয়। পাখির ডানার পেশি আর মানুষের হাতের মাংসপেশির গড়ন বা সক্ষমতা এক নয়। পাখি দীর্ঘ সময় ডানা নেড়ে হাজার হাজার মাইল উড়তে সক্ষম। মানুষের পক্ষে কখনোই নিজ বাহুবলে ডানা নাড়িয়ে আকাশে ওড়া সম্ভব নয়। পাখি যেমন নিজেই ভূমি থেকে সরাসরি অনেক উঁচুতে উড্ডয়ন করে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে, মানুষ তা পারে না। মানুষ মাটি থেকে পাখা নেড়ে উঁচুতে উঠতে পারে না; পাহাড় বা টাওয়ারের মতো উঁচু কোনো জায়গা তাঁর লাগে।
তাই শুধু ডানায় ভর করে নয়, অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে ওড়ার পথ খুঁজতে লাগল মানুষ।
বেলুন পর্ব
চীনে বিভিন্ন উৎসব বা যুদ্ধে ফানুস ওড়ানোর চল বহু পুরনো। ফানুসের নিচের দিকে বেঁধে দেওয়া বাতির আগুনে ভেতরের বাতাস গরম হয়ে উঠলে ফানুস উড়তে শুরু করে। ভেতরের গরম বাতাস ফানুসের বাইরে থাকা বাতাসের তুলনায় হালকা বলে ওপর দিকে উঠতে থাকে। আবার আগুনের তাপে ভেতরের বাতাস প্রসারিত হলে ফানুস থেকে কিছু বাতাস বেরিয়ে যায়, ফলে ফানুসের ভেতরে থাকা বাতাসের ঘনত্বও কমে যায়। বাইরের বাতাসের ঘনত্ব বেশি থাকায় বাতাসে ফানুস উড়তে থাকে।
গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস আজ থেকে ২ হাজার ২০০ বছর আগে জানিয়েছিলেন যেকোনো বস্তু তরলে নিমজ্জিত করলে সেটি কিছু ওজন হারায়। বস্তুটি যে পরিমাণ তরল অপসারণ করে, তার ওজন বস্তুটির হারানো ওজনের সমান। ফানুসের ব্যবহার আর আর্কিমিডিসের সুত্র বহু আগে থেকেই আমাদের জানা। কিন্তু এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে বেলুনে করে আকাশে ওড়ার জন্য আমাদের হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেনডিশ ১৭৬৬ সালে হাইড্রোজেন গ্যাস বাতাস থেকে আলাদা করতে সক্ষম হলেন। হাইড্রোজেন গ্যাস বাতাসের চেয়ে ওজনে হালকা, তাই কোনো থলেতে এই গ্যাস পুরে দিলে সেটি বাতাসে ভেসে থাকে।
গরম বাতাসে ভরা বেলুন তৈরি করে প্রথম তা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন ফ্রান্সের দুই ভাই—জাক এতিয়েঁ মঁগলফিয়ে ও জোসেফ মিশেল মঁগলফিয়ে। মঁগলফিয়ে ভাইয়েরা কাগজ দিয়ে মস্ত বড় একটা বেলুন তৈরি করে তার নিচে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে বেলুনটা ভরে দিলেন। অমনি বেলুনটা বাতাসে উড়ে গেল। এভাবে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ঠিক হলো, ঘোষণা দিয়ে বেলুন ওড়ানো হবে।
দিনটি ছিল ১৭৮৩ সালের ৫ জুন। ছোট্ট শহর অ্যানোনের একটি খোলা উন্মুক্ত স্থানে প্রচুর লোক জড়ো হলো। মঁগলফিয়েরা বেলুন ওড়ানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জনগণ। সামান্য ভেজা কিছু খড়কুটো বেলুনের নিচে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। পাতলা লিনেন কাপড় ও তার নিচে তিন প্রস্ত পাতলা কাগজের স্তর দিয়ে বানানো বেলুনটি আগুনের ধোঁয়া ও গরম বাতাসে পূর্ণ হতেই আকাশে উড়ে গেল। ১০৫ ফুট বেধের বেলুনটি ধীরে ধীরে প্রায় ছয় হাজার ফুট ওপরে উঠে গেল। গরম বাতাস ঠান্ডা হয়ে এলে বেলুনটি ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে। এ ঘটনার কথা দ্রুত প্যারিসসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন মঁগলফিয়ে ভাইয়েরা।
কয়েক মাস পরই জাক এ সি শার্ল নামে এক ফরাসি বিজ্ঞানী মহাসমারোহে একটি বেলুনে প্রথম হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি করে আকাশে ওড়ালেন। সেই বেলুন আকাশে ভেসে ভেসে কয়েক মাইল দূরে একটি গ্রামের মাঠে গিয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষ দানবের মতো গোল একটা জিনিসকে আকাশ থেকে মাঠে এসে পড়তে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। হাইড্রোজেন গ্যাস বেরিয়ে আসার সময় বেলুন থেকে ফোসফোস আওয়াজ আসতে থাকে। তারমধ্যে আবার দুজন যাজক এসে তাদের বলে ওই গোলাকার বস্তুর মধ্যে একটি দানব লুকিয়ে আছে। সব মিলিয়ে গ্রামবাসীরা বেশ ভয়ই পেয়ে যায়; অশুভ কোনো দানব বা জন্তু ভেবে ওটাকে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে আচ্ছা মতো পেটাতে থাকে। এভাবে সবাই মিলে বেলুনটাকে তারা ছিন্নভিন্ন করে।
পরের মাসেই বেলুনে ওড়ায় কে প্রথম, এই নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মঁগলফিয়ে ভাইদের আবার তাঁদের বেলুন উড়িয়ে দেখানোর অনুরোধ করে রয়েল একাডেমি অব সায়েন্স।
ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই, ফরাসি সম্রাজ্ঞী মারি আঁতোয়ানেৎসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে ১৭৮৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভার্সাইতে বেলুন ওড়ানোর ব্যবস্থা হলো। মঁগলফিয়েরা ঠিক করলেন, বেলুনে এবার প্রাণী ওড়ানো হবে। ছোট ঝুড়িতে একটি ভেড়া, একটি মোরগ আর একটি হাঁসকে নিয়ে আকাশে উড়ল বেলুন। কিছুক্ষণ আকাশে থাকার পর একসময় নেমে এল মাটিতে। দেখা গেল ভয়, পেয়ে ভেড়াটি হাঁসের ওপরে উঠে যাওয়ায় সেটি মারা গেছে।
প্রাণী নিয়ে আকাশে বেলুন ওড়ানো সম্ভব, প্রমাণ হয়ে গেল। ওই বছরই পিলেতর দ্য রোজিয়ে ও মার্কুইজ দ্য অরলঁদ নামে দুই ফরাসি ঠিক করলেন, তারা নিজেরাই এবার বেলুনে চড়বেন। মঁগলফিয়েদের সহযোগিতায় তৈরি হল বেলুন। দুর্ঘটনা এড়াতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন রাজা ষোড়শ লুই। কিন্তু এমন দুর্লভ সম্মান কী অপরাধীদের দেওয়া যায়? রাজার কাছে আবেদন করে তাই নিজেদের জন্যই সম্মতিটা আদায় করে নিলেন রোজিয়ে–অরলঁদ।
১৭৮৩ সালের ২১ নভেম্বর বেলুনে আরোহণ করলেন তাঁরা। প্রথম মনুষ্যবাহী বেলুন বলে কথা। ওটাকে তাই খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। নীল রঙের বেলুনটির ওপর রাজা লুই, ১২টি রাশিচক্র, ইগল ইত্যাদির ছবি সোনালি রঙে রাঙানো হলো। দুজনে প্যারিসের পশ্চিমপ্রান্ত থেকে উড়েছিলেন। ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য প্যারিসের উপকণ্ঠে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। ওই দিন ৩ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে বাতাসে ভেসে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা। সারা ফ্রান্সেই এ খবর বেশ আলোড়ন তুলল।
পরের কয়েক বছর ফ্রান্সের আকাশে একের পর এক ওড়ার ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটে চলল। যেমন প্রথম হাইড্রোজেন গ্যাসভর্তি বেলুনে করে মানুষের আকাশ পাড়ি দেওয়া এবং বেলুনে প্রথম নারীর আকাশে ওড়া। ১৭৮৩ সালের ১ ডিসেম্বর হাইড্রোজেন বেলুনে করে প্রফেসর শার্ল ও নিকোলা লুই রোবের দুই ঘণ্টায় ২৭ মাইল পারি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি বেলুনে আকাশপথে ভ্রমণের এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা করে।
১৭৮৫ সালের ৭ জানুয়ারি জ্যঁ-পিয়ের ব্লঁচার ও ড. জন জেফ্রিজ প্রথম বেলুনে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে সক্ষম হন। ব্লঁচার ও জেফ্রিজ ইংল্যান্ডের ডোভার ক্যাসল থেকে উড়ে গিয়ে ফ্রান্সে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে তাঁদের বেলুনটি কিনে নেয় মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল। বেলুনটি এখনো ক্যালাইসের জাদুঘরে রক্ষিত আছে। বেলুন ইতিহাসের অনেক প্রথম রেকর্ডেরই মালিক ব্লঁচার। প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া ছাড়াও তিনি বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রথম বেলুন আরোহণ করেন।
ব্লঁনচারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভিন্ন পথে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে উদ্যোগী হন পিলেতর দ্য রোজিয়ে। ১৭৮৫ সালের ১৫ জুন এক সহযাত্রীকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে উড়াল দিলেন। হাইড্রোজেনভরা বেলুনের নিচে আরেকটি আগুন প্রজ্বলিত ছোট বেলুন যুক্ত করলেন তিনি। হাইড্রোজেন গ্যাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় আকাশে ওড়ার পর রোজিয়ের বেলুনটিতে আগুন ধরে যায়। তিনি ও তাঁর সহযাত্রী পড়ে গিয়ে মারা যান। বেলুনের ইতিহাসের এটি প্রথম দুর্ঘটনা।
মনুষ্যবাহী বেলুন আকাশে ওড়ার আট মাস পর প্রথম আকাশে ওড়ে নারী। ফ্রান্সের লিয়ঁতে ১৭৮৪ সালের ৪ জুন সুইডেনের রাজা তৃতীয় গুস্তাভের সম্মানে ফ্লুরার সঙ্গে বেলুন আরোহণ করেন এলিজাবেথ থিবল। সুইডেনের রাজা তখন লিয়ঁ সফরে এসেছিলেন। বেলুনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লা গুস্তাভ’। এলিজাবেথ থিবল ছিলেন অপেরা গায়ক। আরোহণের সময় তিনি রোমান দেবী মিনার্ভার মতো পোশাক পরেছিলেন এবং সে সময়ের বিখ্যাত একটি অপেরা থেকে দুটি ডুয়েট পরিবেশন করেছিলেন। তবে প্রথম দিকে যেসব নারী আকাশে উড়েছিলেন, তাঁদের প্রায় কাউকেই পরে আর আকাশে উড়তে দেখা যায়নি।
প্রথম যে নারী বেলুন আরোহণকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁর নাম সোফি ব্লঁচার। তিনি ছিলেন বেলুনে প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া জ্যঁ–পিয়ের ব্লঁচারের স্ত্রী। ১৮০৪ সালে স্বামীর সঙ্গে প্রথম বেলুনে চড়েছিলেন তিনি। তিনি প্রথম নারী যিনি ১৮০৫ সালে নিজেই এককভাবে বেলুনে আরোহণ করেছিলেন। ১৮০৯ সালে ব্লঁচারের মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন বেলুনে আরোহণসহ নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন সোফি। তিনি রাতে বেলুনে করে নানা ধরনের আতশবাজির খেলা দেখাতেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বা আকাশে অনেক উচ্চতায় উড়াতেও তিনি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। আল্পস পর্বতমালা ও ইতালি তিনি বেলুনেই অতিক্রম করেছিলেন। সোফি প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮১৯ সালের ৬ জুলাই আকাশে প্রদর্শনী চলাকালে সোফি ব্লঁচারের হাইড্রোজেন বেলুনে আগুন ধরে যায়। বেলুনটি বিধ্বস্ত হলে সোফি মারা যান।
বেলুনে কীভাবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া যায়, কীভাবে বেলুনকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়—তা নিয়েও পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছিল। ইংল্যান্ডের চার্লস গ্রিন ১৮২১ সালে বেলুনে প্রথম কোল গ্যাস ব্যবহার করেন। ১৮৩৬ সালে এক উড়ানে তিনি ৪৮০ মাইল অতিক্রম করেছিলেন, ১৯০৫ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল সেই রেকর্ড।
যুদ্ধক্ষেত্রেও বেলুনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৮৪৯ সালে ভেনিস দখলের এক অভিনব পরিকল্পনা হাতে নেয় অস্ট্রিয়া। ৩৩ পাউন্ড বোমার সঙ্গে আধঘণ্টার ফিউজ লাগিয়ে চালকবিহীন অনেকগুলো বেলুন ভেনিসের পথে উড়িয়ে দেয় তারা। কিন্তু বাতাস প্রতিকূলে থাকায় যথাস্থানে পৌঁছানোর আগেই মাঝ আকাশে বেলুনগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। আলোঝলমল রাতের আকাশে বোমা ফাটতে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে ভেনিসবাসী।
১৭৯৪ সালে বেলজিয়ামের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বেলুন ব্যবহার করেছিল ফরাসিরা। ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে একটি বেলুন বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। এই বেলুন বাহিনী আকাশে উড়ে টেলিগ্রামের তারের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের কথা স্বপক্ষকে জানাত।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের জন্য কয়েকবার আকাশের অনেক উঁচুতে বেলুন ওড়ানো হয়েছিল। ১৮৬২ সালে হেনরি কক্সওয়েল ও জেমস গ্লেসিয়ার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় সাত মাইল ওপরে তাঁদের বেলুন নিয়ে যান। তখন নিম্ন তাপমাত্রায় গ্লেসিয়ারের প্রায় মরার দশা হয়েছিল। অতি দ্রুত বেলুন নিচে নামিয়ে এনে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন তারা। আরও একটি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে ১৮৭৫ সালে দুই সঙ্গীকে নিয়ে প্রায় ৮ হাজার ৬০০ মিটার উঁচুতে উঠেছিলেন ক্যাপ্টেন সিভেল। তবে ওই অভিযানে ক্যাপ্টেন সিভেল ও এক সঙ্গী মারা যান।
জাহাজে চড়ে এবং নানা উপায়ে উত্তর মেরু জয়ের চেষ্টা করছিল মানুষ। তবে বেলুনে করে উত্তর মেরু আবিষ্কারের চেষ্টা আগে কেউ করেনি। বেলুনে উত্তর মেরু অভিযানের সেই চ্যালেঞ্জটিই নিলেন সুইডেনের প্রকৌশলী সলোমন অগাস্ট আন্দ্রে। অর্থায়নে এগিয়ে এলেন রাজা দ্বিতীয় অস্কার, বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল ও সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স। ১৮৯৭ সালের ১১ জুলাই দুই সহযোগীকে নিয়ে বেলুনে উত্তর মেরু অভিযানে গিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান আন্দ্রে। দীর্ঘদিন পর ১৯৩০ সালে দুটি জাহাজ তাঁদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদিসহ দেহাবশেষ খুঁজে পায়।
বেলুন নিয়ে ভিন্ন দুটি কাহিনি বর্ণনা করে এই অধ্যায় শেষ করব।
১৮০৮ সালের প্যারিস। ইম্পেরিয়াল অপেরার এক নারীকে নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে দুই প্রেমিক: এম ডি গ্রান্ডপ্রে ও এম পিক। ফয়সালার জন্য তাঁরা বেছে নিলেন অভিনব এক পথ: বেলুনে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। প্রস্তুতি নিতে এক মাস সময় নিলেন তাঁরা। তৈরি হলো বেলুন। নির্ধারিত দিনে দুজনই একজন করে সহযোগী নিয়ে বেলুনে আকাশে উড়লেন। শর্ত ছিলো কেউ কাউকে সরাসরি গুলি করতে পারবে না, বেলুনে গুলি করতে হবে। বেলুন ছিদ্র হলে গ্যাস বেরিয়ে যাবে আর বেলুনের দ্রুত পতনে মৃত্যু নির্ঘাত। বেলুন দুটি নির্ধারিত উচ্চতায় উঠলে নিচ থেকে সংকেত দেওয়া হলো। প্রথমে গুলি করলেন পিক। মিস। গ্রান্ডপ্রের গুলিতে পিকের বেলুন ছিদ্র হয়ে গেল। গ্যাস বেরিয়ে সজোরে ভূমিতে আছড়ে পড়ল বেলুন, সেখানেই মারা গেল পিক ও তার সহযোগী। বিজয়ী গ্রান্ডপ্রে প্যারিস থেকে সাত লিগ দূরের একটি গ্রামে নিরাপদে সঙ্গীসহ অবতরণ করল।
১৮৬৫ সালের ৯ নভেম্বর একটি অভিনব খবর প্রকাশ করে দ্য ব্রুকলিন ডেইলি ইগল। বেলুনে বিয়ে হবে। নিঃসন্দেহে অভিনব কাণ্ড, অনেকেই তাই বিয়ে দেখতে ভিড় জমালেন। বর ৫০ বছর বয়সী এক বিপত্নীক। নববধূর বয়স ২৫ বছর। বেলুনে গ্যাস ভরার বিষয়টি নিজেই তদারক করছিলেন বর, কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাস উত্পাদন না হওয়ায় বেলুনটিকে উড়ানো যাচ্ছিল না। বরের ওজনও আরেকটি কারণ। বেশ নাদুসনুদুস হওয়ায় বেলুনের ঝুড়িতে তার জায়গা হচ্ছিল না।
এদিকে বিয়ে পড়াবেন যে পাদরি, বেরসিকের মতো তিনিও বেঁকে বসলেন। বললেন, আকাশে স্বর্গের কাছাকাছি বিয়ে পড়াতে তিনি রাজি নন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, মাঝআকাশে শুধু বিয়ের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করা হবে। বাকি আনুষ্ঠানিকতা সব নিচেই সারা হবে। বেলুনেই বিয়ের কাগজে স্বাক্ষর হলো। যদিও বরের অতিরিক্ত ওজনের কারণে নববধূর সঙ্গী তাঁর সৎবোনকে বেলুনে নেওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত বেলুন থেকে যখন নিচে নেমে এলেন, তখন তাঁদের দুজনেরই প্রায় অর্ধহিমায়িত দশা। উপস্থিত লোকজন ব্যঙ্গবিদ্রূপে এই ব্যয়বহুল বিয়ের নিন্দা করে বাড়ি ফিরে গেল।
ভারত অধ্যায়
বেলুন নিয়ে উন্মাদনার এই ঢেউ ভারতীয় উপমহাদেশেও এসে পড়েছিল। চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন, বেতার ইত্যাদি আবিষ্কারের স্বল্প সময়ের মধ্যেই যেমন ভারতে চলে এসেছিল, বেলুনের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছিল। মনুষ্যবাহী বেলুন আকাশে ওড়ার দুই বছরের মধ্যেই ১৭৮৫ সালের ২৯ জুলাই উইন্টন নামে এক বিদেশি কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে বেলুন উড়িয়েছিলেন। বেলুনটির ব্যাস ছিল ৬ ফুট।
কলকাতার প্রথম সার্থক বেলুন আরোহীও কিন্তু একজন ফরাসি, নাম রবার্টসন। দ্য ইংলিশম্যান পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৮৩৬ সালের ১৬ মার্চ বিকেল পাঁচটায় গার্ডেন রিচে স্যার চার্লস মেটকাফের বাড়ির পাশের বাগান থেকে বেলুন উড়বে। খবরটা জানাজানি হওয়ার পর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে গার্ডেন রিচ, গাড়ি-ঘোড়ায় জট লেগে যায়। গঙ্গাতে নৌকায় করেও অনেকে বেলুন ওড়া দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ৯ হাজার ঘনফুট হাইড্রোজেন বহনক্ষম রবার্টসনের বেলুনটির ব্যাস ছিল ১৪ ফুট। বেলুনটি আকাশে উড়লেও হঠাৎই খুব দ্রুত নিচে নেমে আসে। রবার্টসনের দাবি, ওপরে ওঠার পর গরম হাইড্রোজেন গ্যাস ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শ এসে সংকুচিত হওয়ার কারণেই দ্রুত নিচে নেমে আসে বেলুন। যদিও কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, বেলুনে ওঠার সময় তাড়াহুড়ায় গ্যাস ছাড়ার ভাল্বটি রবার্টসন খুলে দেন। ফলে বেলুনটি দ্রুত মাটিতে নেমে আসে।
কলকাতায় এরপর বেলুন ওড়ান কাইট। ১৮৬৫ সালে প্রথম দফায় ব্যর্থ হলেও পরের দফায় তিনি উড্ডয়নে সফল হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ১৮৭৭ সালে এলেন জোসেফ লিন কলকাতার নারকেলডাঙায় ডিসেম্বরে বেলুন নিয়ে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর এলেন পার্সিভাল স্পেন্সার। বম্বেতে বেলুন উড়িয়ে ১৮৮৯ সালে কলকাতা আসেন তিনি। বেলুন ঠিকঠাক ফোলাতে ব্যর্থ হওয়ায় কলকাতায় তাঁর প্রথম প্রদর্শনী ভেস্তে যায়। তাঁর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে। রেসকোর্স ময়দানে নিজেই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করে বেলুনে পুরে আকাশে উড়াল দেন তিনি ।
কলকাতা, দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজ, লখনৌ, আহমেদাবাদ, বেনারসসহ প্রায় সব বড় শহরে বেলুন ওড়ানোর জন্য বিশ্বের নানা দেশ বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে অনেক বেলুন–বীর ভারতে আসতে থাকে। বিশেষ করে ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারতের নানা অঞ্চলের রাজা-মহারাজাদের জন্য বেলুন প্রদর্শনীর আয়োজন অর্থ উপার্জনের একটা ভালো মাধ্যম হয়ে ওঠে।
শুধু যে সাহেবরাই কলকাতার আকাশে উড়েছিলেন, তা কিন্তু না। কলকাতার আকাশে বেলুন নিয়ে ওড়া প্রথম বাঙালি রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্পেন্সারের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। ১৮৮৯ সালের ৪ মে বেলুনে চড়েছিলেন তিনি। রামচন্দ্র ইউরোপীয় বেলুন আরোহীদের মতো দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথম দিকে রামচন্দ্র যখন আকাশে ওড়ার বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন, বেশকিছু ইংরেজি পত্রিকা তাঁর সক্ষমতা নিয়ে নানা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। পরে অবশ্য নেটিভবিরোধী অতিকট্টর সংবাদপত্রগুলোও রামচন্দ্রের সাফল্য ও দক্ষতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিল।
লাহোর থেকে প্রকাশিত দ্য সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে অন্যান্য শহরসহ ঢাকার আকাশে ওড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন রামচন্দ্র। যত দূর জানা যায়, রামচন্দ্রের আর ঢাকার আকাশে ওড়া হয়নি। এই বাঙালি ১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট মারা যান। মেজর হ্যারি হবস তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, রামচন্দ্রের কন্যাও দুঃসাহসে কিছু কম ছিল না। সে–ও তার বাবার সঙ্গে কয়েকবার বেলুনে উড়েছিল।
রামচন্দ্রের সাফল্যে আকৃষ্ট হয়ে আরও দুজন বাঙালি বেলুন আরোহনে যুক্ত হয়েছিলেন। একজন প্রবোধচন্দ্র সাহা, পরে যিনি এককভাবেও উড়েছিলেন এবং দ্বিতীয়জন যোগেশচন্দ্র চৌধুরী। যোগেশচন্দ্র বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজে বেলুনে উড়েছিলেন। তবে এই দুজনের কেউই অবশ্য বেলুন উড্ডয়নে রামচন্দ্রের অবস্থানে নিজেদের নিয়ে যেতে পারেননি।
ঢাকা অধ্যায়
কলকাতার বেলুন নিয়ে যখন এত হইহুল্লোড়, তখন ঢাকায় কি তার কোনো প্রভাব পড়েছিল—এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। হ্যাঁ ঢাকার আকাশেও উড়েছিল বেলুন। অবশ্য যিনি এই ইতিহাসের সূচনা করেছিলেন, তিনি কোনো বাঙালি ছিলেন না। ছিলেন বিদেশী ও নারী।
মরমী কবি হাসন রাজার ছেলে গনিউর রাজার দিনপঞ্জিতে প্রথম ঘটনাটির উল্লেখ পাই। বেলুন ওড়ানোর ঘটনাটি নিজ চোখে দেখেছিলেন গনিউর রাজা। তাঁর লেখায় অবশ্য বেলুনচারিনীর নামধাম ছিল না। ঢাকার প্রথম আকাশচারী সম্পর্কে জানার কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠল। ঠিক করলাম, মেয়েটির পরিচয় ও প্রকৃত কাহিনি বের করব।
১৯৮৯ সালের ১ আগস্ট ঘটনাচক্রে ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান খাজা হালিমের কাছে পুরোনো একটি আলোকচিত্র দেখি। আধফোলা বিরাট একটি বেলুনের ছবি। সে বেলুন-ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দেশি–বিদেশি কয়েকজন মানুষ। ছবি থেকে গনিউর রাজার বিবরণের একটি শক্ত প্রমাণ মিলল।
গনিউর রাজা লিখেছিলেন, মেয়েটি ঢাকায় বেলুনে চড়ে উড়েছিলেন, কিন্তু প্যারাস্যুটে করে নিচে নেমে আসার সময় দুর্ঘটনায় মারা পড়েন। গনিউর রাজা ঢাকায় এসেছিলেন বাংলা ১২৯৯ সনে। সে হিসেবে খ্রিষ্টীয় ১৮৯২ সাল।
পুরান ঢাকার সেন্ট টমাস গির্জায় রক্ষিত পুরোনো ডেথ রেজিস্টার খুঁজলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেল বেলুনচারিনীর নাম ও মৃত্যুর তারিখ। নাম জিনেট ভান তাসেল। মৃত্যুর তারিখ ১৮ মার্চ ১৮৯২। বয়সের ঘরে লেখা ২৪ বছর। পেশা আকাশচারী (অ্যারোনট)। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা আছে দুর্ঘটনা।
মেয়েটিকে নিশ্চয়ই নারিন্দার খ্রিষ্টান সমাধিস্থলে দাফন করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে অনেক খুঁজেও জিনেট নামের কোনো সমাধিফলক পাওয়া গেল না।
মৃত্যুর দিনটির আগের ও পরের ঘটনা জানতে শুরু হলো খোঁজ। গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি বিভাগে। ওখানে রক্ষিত সে সময়ের পত্রপত্রিকার মাইক্রোফিল্ম ঘাঁটতে শুরু করলাম। ঘটনা আস্তে আস্তে জোড়া লাগতে শুরু করল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেল, ঢাকার আকাশে বেলুনে ওড়ার কয়েক দিন আগে থেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকাবাসীকে জানানো হয়েছিল। তাই ঘটনা দেখতে লোক হয়েছিল বেশুমার। ১৮৯২ সালের ১৬ মার্চ বিকেলে আহসান মঞ্জিলের প্রাঙ্গণ, ছাদ ও বুড়িগঙ্গার দুই ধারের দালানগুলোর ওপরের অংশ মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে যায়। শত শত মানুষ অবস্থান নেয় নদীর মধ্যে, নৌকায়।
ঢাকায় এসে বেলুন ওড়ানোর জন্য কলকাতায় গিয়ে জিনেট ও তাঁর স্বামী পার্ক এ ভান তাসেলকে ১৮৯২ সালের ১০ মার্চ চুক্তিবদ্ধ করেন নবাব আহসানউল্লাহ। চুক্তি অনুযায়ী ১৬ মার্চ বিকেলে বেলুনে করে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে আকাশে ওড়েন জিনেট। আকাশপথে ঠিকঠাকই বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে এপারে আসেন তিনি। ভাসতে ভাসতে উঠে যান প্রায় ছয় হাজার ফুট। একসময় নিচে নামার জন্য প্যারাস্যুটে করে ঝাঁপ দেন। প্যারাস্যুট ভাসতে ভাসতে শাহবাগে নবাবদের বাগানবাড়ির একটি উঁচু ঝাউগাছে আটকে যায়। জিনেটও তাতে আটকা পড়েন। মাটি থেকে ১৫-২০ ফুট ওপরে অসহায়ের মতো ঝুলতে থাকেন তিনি।
ঢাকার এক ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা পর পর তিনটি বাঁশ বেঁধে তার সাহায্যে জিনেটকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন। নেমে আসার সময় বাঁশের বাঁধন হঠাৎ খুলে যায়। মাটিতে আছড়ে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত পান জিনেট। প্রায় অচেতন জিনেট ১৮ মার্চ রাত একটায় মারা যান।
জিনেটের মৃত্যু ইংরেজ প্রশাসন ও ঢাকাবাসীকে যেন মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তার মৃত্যুর জন্য ইংরেজ প্রশাসনকে দায় দিচ্ছিল ঢাকাবাসী। তারা সম্ভবত ভাবছিল, জিনেটের করুণ মৃত্যুর পেছনে আছে তাঁকে উদ্ধার করার ব্যাপারে ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি। অন্যদিকে ইংরেজি পত্রপত্রিকা এই বলে অভিযোগ তুলল যে, ঢাকার অধিবাসীরা গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের করার কিছু ছিল না।
জিনেটকে সমাহিত করার সময় নবাব আহসানউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন না। ইংরেজ প্রশাসনের বিপক্ষে যেসব বিতর্ক উঠেছিল, তিনি সম্ভবত তা এড়াতে চেয়েছিলেন। জিনেটের স্বামী পার্ক এ ভান তাসেল কিছুদিন পর ঢাকা ছেড়ে চলে যান। জিনেটের মৃত্যুর ঘটনা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়।
আগেই বলেছি, জিনেটের কবরে কোনো এপিটাফ ছিল না। তার পরও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় তাঁর নামলিপিহীন কবরটি উদ্ধার করি।
ঢাকায় পাওয়া জিনেটের বেলুনের ছবিটি তুলেছিলেন বিখ্যাত জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিত্স কাপ। জিনেটের ছবি বিক্রির জন্য তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। বেলুনের ছবিটি আগে পেলেও তাঁর তোলা জিনেটের কোনো ছবি তখন পাইনি। জিনেটের উত্তরসূরীদের সূত্রে সম্প্রতি সেটিও পাওয়া গেল।
জিনেটের সমাধিটি নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানে এখনো টিকে আছে। নামলিপিহীন এই সাদামাটা কবরটি অযত্নে ও আগাছায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। বাংলাদেশে প্রথম আকাশে জয়ের স্মারক জিনেটের এই সমাধিটি রক্ষা করা উচিত।
জিনেটের যে পরিচয় এতদিন আমরা পেয়েছি, তার মুল সূত্র ছিল সে সময়ের ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দ্য বেঙ্গল টাইমস ও দ্য ইংলিশম্যান। জিনেটের মেইডেন বা প্রকৃত নাম কী ছিল, সেটা তখন জানা সম্ভব হয়নি; যেহেতু তাঁর নামের শেষে স্বামীর পদবি ছিল। দীর্ঘদিন জিনিয়লজি–সম্পর্কিত ব্লগ, পার্ক ভান তাসেলের পরিবারের ওপর ব্লগ এবং সম্প্রতি জিনেটের স্বামী পার্ক ভান তাসেলের ওপর লেখক গ্যারি বি ফোগেলের লেখা পার্ক ভান তাসেল অ্যান্ড দ্য রাইজ অব বেলুনিং ইন দ্য ওয়েস্ট থেকে জিনেটের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। বরং তখনকার পত্রিকায় জিনেটের যে স্বল্প পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যের বেশ গরমিল।
জিনিয়লজি–সম্পর্কিত ব্লগে দেখা যায়, জিনেটের প্রকৃত বা কুমারী নাম জেনেট বা জেনি রুমারি। জন্ম ১৮৬৫ সালে।
সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছিল, পেশায় জিনেট জিমন্যাস্ট। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন আমেরিকার সিনসিনাটির ওহাইওতে। ধর্মবিশ্বাসে প্রেসবাইটেরিয়ান খ্রিষ্টান। পত্রিকায় আরও বলা হয়েছিল, তাঁর বাবা একজন স্থপতি, যিনি শিকাগো প্রদর্শনীতে নিয়োজিত ছিলেন। জিনেট ছিলেন পরিবারের একমাত্র সন্তান। চার বছর হয় বেলুন আরোহণকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এক বর্ণনায় দেখা যায় ওড়ার সুবিধার্থে আঁটসাঁট হলুদ ও ক্রিমসন রঙের সিল্কের পোশাক পরতেন জিনেট।
এখন পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জিনেটের বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে জর্জ জন রুমারি ও জেনটিংলে। আট ভাই–বোনের মধ্যে জিনেট সম্ভবত চতুর্থ। জিনেটের বাবা শেষ বয়সে লন্ডন থেকে ২৭ মাইল দক্ষিণ–পশ্চিমে সাসেক্সের ইস্ট গ্রিন স্টেট শহরে ওয়ার্ক হাউসে (নিম্নবিত্তের আবাসন) বসবাস করতেন। সেখানেই মারা যান। পেশায় তিনি স্থপতি নন, কাঠমিস্ত্রি। জিনেটের জন্ম যে আমেরিকায়, সে বিষয়েও গ্রহণযোগ্য কোনো দলিল বা তথ্য পাওয়া যায়নি। জিনেটের বাবা সম্ভবত চারবার বিয়ে করেন। জিনেটের মা জেনটিংলে ১৮৭৫ সালে মারা যান। আগেই বলেছি যে জিনেট সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। ভারতে আসার আগে তাঁর বেলুন আরোহণ ও প্যারাসুট ঝাঁপ দেওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।
তবে তার স্বামীর দীর্ঘ রোমাঞ্চকর জীবন বিষয়ে বেশ তথ্য পাওয়া যায়। পার্কার অ্যালবার্ট ভান তাসেল বা পি এ ভান তাসেল ১৮৫৩ সালের ২৬ জুলাই আমেরিকার ইন্ডিয়ানার কাস কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। আলবাকারকিতে প্রথম বেলুন আরোহণ করেছিলেন। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, হাওয়াই, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ নানা দেশে বেলুন প্রদর্শনী করেছেন পার্ক। তাঁর দলের অনেক নারী বেলুন আরোহণ ও ঝাঁপ দিতেন; যাঁদের সবার নামের শেষেই জুড়ে দেওয়া হতো ভান তাসেল পদবি। এর ফলে বিশ্বের সর্বত্রই খবর পরিবেশনের সময় এক নারীর সঙ্গে অন্যের নাম বা অভিজ্ঞতা গুলিয়ে যেত।
১৮৯১ সালের ৪ অক্টোবর ‘পেশোয়ার’ জাহাজে করে লন্ডন থেকে বম্বে আসেন পার্ক ভান তাসেল। এটি তার দ্বিতীয় ভারত আগমন। এবারের সফরের উদ্দেশ্য কলকাতা থেকে বম্বে পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ মাইল দীর্ঘ বেলুনযাত্রা। আর এ যাত্রায় তার সহযাত্রী এক নারী—জিনেট রুমারি। এখানে নিজেদের তাঁরা মিস্টার এবং মিসেস ভান তাসেল হিসেবে পরিচিত করালেন।
জিনেট পার্কের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন কি না, সে বিষয়ে ফোগেল নিশ্চিত নন। তিনি ধরে নিয়েছেন হয়তো পার্কের স্ত্রী ছিলেন জিনেট। তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল পর্যালোচনা করলে জিনেট যে পার্কের স্ত্রী ছিলেন, তা মেনে নিতে বাধা থাকবে না। প্রথমত ‘পেশোয়ার’ জাহাজে মিস্টার এবং মিসেস ভান তাসেল নিজেদের স্বামী–স্ত্রী হিসেবেই পরিচিত করেন। দ্বিতীয়ত, আমার খুঁজে পাওয়া জিনেটের ডেথ রেজিস্টারে জিনেটের পদবি রুমারি নয়, ভান তাসেল। ডেথ রেজিস্টার একটি আনুষ্ঠানিক বা দাপ্তরিক নথি। সেখানে জিনেটের পদবি ভান তাসেল উল্লেখ করার সুযোগ নেই, যদি না তিনি পার্কের বিবাহিত স্ত্রী হন। তৃতীয়ত, তাঁদের ম্যানেজার কলভেলির পত্রিকায় প্রেরিত একটি চিঠির কথা উল্লেখ করতে চাই। জিনেটের মৃত্যু নিয়ে বিতর্কের মাঝে ১৮৯২ সালের ১৯ মার্চ দ্য বেঙ্গল টাইমস-এ ভান তাসেল ও নিজের পক্ষ থেকে একটি পত্র প্রেরণ করেন কলভেলি, ওই পত্রিকায় ২৩ মার্চ যা প্রকাশিত হয়। পত্রের প্রথম ও শেষ লাইনটি মূল ইংরেজিতেই এখানে তুলে ধরছি:
স্যার—অ্যাজ দিস মে বি মাই লাস্ট কমিউনিকেশন উইথ ইউ, আই উইশ অন বিহাফ অব মি. ভান তাসেল অ্যান্ড মাইসেলফ, টু ইমপ্রেস আপন ইউ ইন এভরি ওয়ে, দ্যাট উই এনশিউর নোবডি ফর দ্য স্যাড এন্ডিং অব মিসেস ফন তাসেল…
হি (মি. ভান তাসেল) লিভস বিহাইন্ড হিম, আ ব্রেভ অ্যান্ড ফেইথফুল ওয়াইফ, আ গুড অ্যান্ড কারেজিয়াস উওমেন অ্যান্ড হিজ লস ইজ ইররিপেয়ারেবল।
ম্যানেজার হিসেবে কলভেলি পার্ক ও জিনেটের বেলুন প্রদর্শনী সংক্রান্ত সব বিষয় তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। স্বভাবতই তিনি পার্ক ও জিনেটের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে অবগত থাকবেন ধরে নেওয়া যায়। চিঠিতে ‘মি. ভান তাসেল’ ও ‘মিসেস ভান তাসেল’ এবং ‘একজন সাহসী ও বিশ্বস্ত স্ত্রী’ হিসেবে জিনেটকে উল্লেখ করায় খুব দৃঢ়তার সঙ্গে ধরে নেওয়া যায় যে জিনেট পার্কের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন। তবে জিনেটের জন্ম আমেরিকায়—পত্রিকার এই তথ্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সে সময়ে পত্রপত্রিকায় পার্ক ভান তাসেল ও তাঁর ট্রুপের সদস্যদের নিয়ে প্রায়ই ভুল তথ্য প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া পার্ক ভান তাসেল এ অনেক সময় প্রকৃত ঘটনা বাড়িয়ে বলতেন। যেমন পত্রিকায় জিনেটের বেলুন আরোহণের বিষয়ে বলা হয় যে তিনি ৩০০ বার বেলুনে চড়েন এবং ৪০ বার প্যারাসুট ঝাঁপ দেন। অথচ ভারতে আসার আগে লন্ডনে জিনেটের বেলুন আরোহণ বা ঝাঁপ দেওয়ার কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। কোনো কোনো পত্রিকা জিনেটের মৃত্যুসংবাদে ভুল করে তাকে ভ্যালেরি ফ্রেইটাস বলে উল্লেখ করে। ১৮৯২ সালের ২০ এপ্রিল এলাহাবাদের মর্নিং পোস্ট পত্রিকা এই বিষয়ে একটি চিঠি প্রকাশ করে। নাম না থাকলেও চিঠিটি পড়ে বোঝা যায় পত্রলেখক ভ্যালেরি ফ্রেইটাসের পরিচিত। তিনি উল্লেখ করেন, যে তরুণী (ঢাকায়) জীবন হারিয়েছেন, তিনি জীবনে মাত্র ছয়বার বেলুন আরোহণ ও প্যারাসুট ঝাঁপ দিয়েছেন। কিন্তু মিস ভ্যালেরি ভান তাসেল—যিনি এলাহাবাদে আছেন—অস্ট্রেলিয়া, জাভা, চীন, জাপান, ম্যানিলা, বার্মাসহ ভারতের হায়দরাবাদ, পুনে, মহিশুর, জয়পুর, ভবনগর, জুনাগড়, ইন্দোর, জামনগর, আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বেলুন আরোহণ ও প্যারাসুট ঝাঁপ দিয়েছেন। তিনি এর সপক্ষে প্রমাণাদি দিতে প্রস্তুত এবং তার বিশ্বাস, পি এ ভান তাসেল এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন না। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে প্রফেসর ভান তাসেল ইউরোপে থেকে জিনেটকে নিয়ে আসেন। বম্বেতেই প্রথম বেলুন আরোহণ করেন জিনেট।
ভারতে আসার পর ১৮৯১ সালে ১৮ অক্টোবর বম্বেতে প্রথম বেলুন আরোহণ করেন জিনেট ভান তাসেল। এরপর এলাহাবাদ, দিল্লি, লখনৌ ও কলকাতাতে বেলুন ওড়ান।
কলকাতা থেকে বোম্বে পর্যন্ত বেলুনযাত্রার যে পরিকল্পনা তাদের ছিল, তা বাস্তবায়ন উপযোগী আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। অপেক্ষার সময়টুকু বসে নষ্ট না করে কয়েকটি বেলুন প্রদর্শনীতে অংশ নেন তাঁরা। এর মধ্যে ঢাকার বেলুন আরোহণ প্রদর্শনীটিও ছিল। ঢাকার আগে ১৮৯২ সালে ১৬ জানুয়ারি মাদ্রাজে একটি প্রদর্শনী করেন তাঁরা। পরে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অ্যাগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি গার্ডেনে বেলুন আরোহণ ও প্যারাসুট ঝাঁপ দিয়েছিলেন জিনেট। সেই প্রদর্শনীর সময় সিপাহী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়, যার খবর আমরা ঢাকা প্রকাশ–এ পাই। তবে উড্ডয়ন ও প্যারাসুট ঝাঁপ সফলভাবেই শেষ করেছিলেন জিনেট। এই প্রদর্শনীর পর ১৪ মার্চ বিকেলে ঢাকায় আসেন পার্ক ও জিনেট ভান তাসেল। ১৬ তারিখ প্রদর্শনীতে অংশ নেন।
ধরে নেওয়া যায়, জিনেটের মৃত্যুতে পি এ ভান তাসেল মর্মাহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর বেশ কয়েক মাস আর বেলুন আরোহণ করেননি। কলকাতা-বম্বে বেলুনযাত্রার পরিকল্পনাও তিনি ত্যাগ করেন। ১৮৯২ সালের আগস্টে দিল্লির কুইন্স গার্ডেন থেকে আবার প্রদর্শনী শুরু করেন। ১৮৯৪ সালের ৬ আগস্ট পুনরায় ভারত ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পার্ক। শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা, ইরান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স এবং শেষে লন্ডনে প্রদর্শনী করে ১৮৯৫ সালে আবার ভারত ফিরে আসেন। বম্বে ও রামপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বেলুন আরোহণ করেন। লর্ড কার্জন ও তাঁর স্ত্রীর সম্মানেও বেলুন আরোহণ করেছিলেন পার্ক। ১৯০০ সালের অক্টোবরে লখনৌতে পার্কের স্ট্রোক করে। অসুস্থ হয়ে ১৯০১ সালে আমেরিকার ফিরে যান। সেখানে দীর্ঘদিন বেলুন আরোহণসহ নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ছিলেন। পার্ক ছয়বার বিয়ে করেছিলেন। শেষ বয়সে তাঁর বোনের কাছে চলে যান। ১৯৩০ সালের ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে চিঠি লেখা অবস্থায় মারা যান পার্ক ভান তাসেল। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
নয়া সুচনা
দিনটি ছিল ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের একটা বাগানবাড়িতে জড়ো হয়েছেন কয়েকজন ঢাকাবাসী। উদ্দেশ্য ঢাকায় জিনেটের বেলুন আরোহণের ১১৯ বছরের মাথায় আবার বেলুন উড্ডয়ন। এ উদ্দেশ্যে সদ্যই চীন থেকে একটি হট এয়ার বেলুন কিনে এনেছেন শাজাহান মৃধা। বিকেলে সবার উপস্থিতিতে সেটা ওড়ানো হবে। গ্যাস বার্নার জ্বালিয়ে বেলুনটি ফোলাতে লাগলেন মৃধা। কেউ কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। ক্রমে বেলুনটি বৃহৎ আকার ধারণ করে। একসময় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বেলুনটির নিচে ঝোলানো বাস্কেটে উঠে পড়লেন শাজাহান মৃধা। একটি লম্বা দড়ির এক প্রান্ত বেলুনে ও অন্য প্রান্ত ভূমিতে হুকের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে বেলুনটি ওপরে উঠতে শুরু করল। প্রায় ২০০ ফুট উঠে বাতাসে স্থির হল। আনন্দে সবাই করতালি দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ শূন্যে অবস্থানের পর বেলুনসহ নিচে নেমে আসেন মৃধা। এরপর বন্ধুদেরসহ আর কয়েকবার আকাশে উড়লেন।
সেদিনের এই বেলুন ওড়ানোটা ছিল পরীক্ষামূলক। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি বাঙালিদের বেলুন আরোহণের ঐতিহাসিক সূচনা হলো। এরপরই জনসমক্ষে বেলুন ওড়াতে মনস্থ করলেন মৃধা। যে ঢাকার আকাশে উড়েছিলেন জিনেট, সেই ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত আউটার স্টেডিয়ামে ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে প্রথম জনসমক্ষে বেলুনে আরোহণ করলেন শাজাহান মৃধা। সেদিন বেশ জনসমাগম হলো। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন সে সময়ের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী আহাদ আলী।
এরপর আরও বেশ কয়েকবার বেলুন প্রদর্শনী করেন শাজাহান মৃধা। তাঁর বেলুনের নাম দিয়েছিলেন ‘জয় বাংলা’। লাল, নীল, সবুজ ডোরাকাটা হলুদ বেলুনটিতে ছিল ডাবল বার্নার। পামকিন টাইপ, চীনের তৈরি বেলুনটি পাঁচজন যাত্রী বহনক্ষম। বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও বেলুন উড়িয়েছিলেন মৃধা। ২০১২ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে জাতীয় ঘুড়ি উত্সবে বেলুন ওড়ান। শাজাহান মৃধা একজন ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবেশবিদ। আসামের তেজপুর ক্যান্টনমেন্টে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ২ নম্বর সেক্টরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বিজ্ঞান সংগঠক, পরিবেশবাদী, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মৃধা বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি।
২০১২ সালের মার্চে তিনি ভারতের জয়পুরে হটএয়ার বেলুনের সংক্ষিপ্ত উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
১৭৮৩ সালের ৫ জুলাই ফ্রান্সের ছোট শহর আনোনে বেলুন উড়িয়ে মানুষের হাজার বছরের আকাশে ওড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের যে সূচনা মঁগলফিয়ে ভাইয়েরা করেছিলেন, তার জোয়ার রাইট ভাইদের প্লেন আবিষ্কারের বেশ পরেও অনেক বছর অটুট ছিল। আকাশপথে যাতায়াতের জন্য দীর্ঘকাল মানুষ বেলুনকেই বেছে নিয়েছিল। বিমানের উন্নতির ফলে বেলুনের ব্যবহার কমে গেলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। যে ঝুঁকি নিয়ে সে যুগে মানুষ আকাশে উড়েছিল, বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাণ দিয়েছিল, সেই চেষ্টা, ত্যাগের ফলাফল আজ আমরা ভোগ করছি।
আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে বেলুন ওড়ে। নানা উত্সব বা পর্যটনকারী আকাশে উড়ে বেড়ান। আকাশে বেলুন নিয়ে ভেসে বেড়ানোর পেছনে সুপ্ত হয়ে আছে শুরুর সেই প্রচেষ্টার দিনগুলো।