বিয়ের পাত্র-পাত্রীর তথ্য যাচাইসেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি
পরিচিতদের মধ্যে বিয়ে হলে দুই পক্ষেরই একে অপরের বিষয়ে জানাশোনা থাকে। কিন্তু তেমনটি না হলে অনেকটা ‘অন্ধকারে’ থেকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বর–কনে। বিয়ের পর অনেক সময় একজনের কাছে অন্যজনের দোষত্রুটি বেরিয়ে আসে। তখন ঘটে বিপত্তি, সংসার টেকানোই দায় হয়ে পড়ে।
এমনটি যাতে না ঘটে, সে জন্য পূর্বপরিচিতদের বাইরে বিয়ে করতে যাওয়া বর–কনে এবং তাঁদের পরিবারের বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ের সেবা দিচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। হুমায়রাডটকমডটবিডি নামে এই প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে। তারা বিয়েসংক্রান্ত অন্যান্য সেবার পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের কাজও করে দিচ্ছে।
বর বা কনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না, আগে বিয়ে করেছিলেন কি না, মাদকাসক্ত কি না, প্রতিবেশীরা ওই পাত্র বা পাত্রী সম্পর্কে কেমন কথা বলছেন, বিয়ের জন্য পাঠানো জীবনবৃত্তান্তে শিক্ষাগত যে তথ্য দিয়েছেন, তা সঠিক কি না, পাত্র বা পাত্রীর পরিবারের অন্য সদস্যরা কেমন, পাত্র–পাত্রীর জীবনযাপনের ধরন, এমনকি তাঁরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতক্ষণ সময় কাটাচ্ছেন অথবা পাত্র বা পাত্রীর সম্পর্কে তাঁদের বন্ধুরা কী বলছেন—এসব তথ্য জানার জন্য আবেদন পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
হুমায়রাডটকমডটবিডির প্রতিষ্ঠাতা মেজবাহ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘বিয়েতে আমাদের বাপ-দাদারা এই গোয়েন্দাগিরির কাজটা করতেন। বলা যায়, বাপ-দাদাদের এই কাজই এখন আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করছি। ব্যস্ত জীবনে এখন অনেক পরিবারের পক্ষে তথ্যগুলো সংগ্রহ করাটাও কঠিন হয়ে গেছে। তাই এই দায়িত্ব অনেকেই আমাদের দিচ্ছেন।’
২০১৭ সালে এই সেবা চালুর পর এখন পর্যন্ত পাত্র বা পাত্রীর তথ্য যাচাইয়ে আড়াই শতাধিক আবেদন পেয়েছেন বলে জানালেন মেজবাহ আহমেদ।
প্রতিষ্ঠানটি চালু করার আগে মেজবাহ আহমেদ একটি চাকরি করতেন। সেই চাকরি থেকে জমানো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসাটি চালু করেছিলেন। বর্তমানে ১৫টি কম্পিউটারে কর্মীরা কাজ করছেন। শীতের সময় বিয়ের মৌসুমে মাসিক আয় চার লাখ টাকাও হয়। ১১ জন বেতনভুক্ত কর্মীর পাশাপাশি তথ্য যাচাইয়ে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ৬০ জন। রাজশাহীতে হাইটেক পার্কেও আরেকটি অফিস খোলার চিন্তাভাবনা চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন মেজবাহ। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করার পর একটু ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করতে চেয়েছিলাম। তখন মনে হলো, দুর্যোগসহ যা-ই ঘটুক, বিয়ে কিন্তু কখনো থেমে থাকে না। তাই ব্যবসাও সব সময় চালু রাখা সম্ভব হবে।’
তথ্য যাচাইসেবার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বর বা কনেপক্ষের বাজেট অনুযায়ী দেশসেরা বাবুর্চির সন্ধান দেওয়া, ফটোগ্রাফার ও কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করে দেওয়া, বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র বানিয়ে দেওয়া, বিয়ের গয়না (ইমিটেশন), বরের শেরওয়ানি ভাড়া দেওয়ার কাজ করছে। এ ছাড়া বিয়ের মঞ্চ, গেট বা গাড়ি সাজিয়ে দেওয়া, পালকি অথবা ব্যান্ড পার্টি ঠিক করে দেওয়া, বিয়ের পর বর ও কনের জন্য হানিমুন প্যাকেজ ঠিক করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করছে তারা।
‘দুই পক্ষেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়’
তথ্য যাচাইসেবা নিয়ে মেজবাহ আহমেদ বললেন, নানা কারণে দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিয়েতে ছেলে বা মেয়েপক্ষ অনেক সময় তথ্য গোপন করে। বিয়ের পর তথ্যগুলো জানাজানি হলে তখন আর বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। বিয়ের আগেই তথ্যগুলো জানা সম্ভব হলে দুই পক্ষেরই বিয়ের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।
বিবাহবিচ্ছেদ যদি কিছুটাও ঠেকানো যায়, সে উদ্দেশ্যেই এ সেবা চালু করা হয়েছে বলে জানান মেজবাহ আহমেদ। তিনি বলেন, এমনও দেখা গেছে, তথ্য সংগ্রহের পর জানা যায়, ছেলে বা মেয়ে হয়তো অনেক আগেই পালিয়ে বিয়ে করেছেন অথবা ছেলে বা মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে, পরিবার জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে। বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব। পরিবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবে কি না, সে বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয় না।
গত ১৩ জুন প্রথম আলোতে ‘ঢাকায় ৪০ মিনিটে ১টি তালাক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ৭ হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি) ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনও বলছে, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী।
মেজবাহ আহমেদ জানান, আবেদন করার প্রথম শর্ত হচ্ছে, ছেলে বা মেয়ের জীবনবৃত্তান্ত থাকতে হবে। আবেদনকারী কোন কোন তথ্য জানতে চাইছেন, তার ভিত্তিতে টাকাপয়সার হিসাব করা হয়। সংস্থাটির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, গোল্ড, ডায়মন্ড ও প্লাটিনাম নামে তিনটি প্যাকেজ আছে। চারটি তথ্য জানার গোল্ড প্যাকেজের জন্য আবেদনকারীকে দিতে হয় ১৯ হাজার ৯৯৯ টাকা। আটটি তথ্যের জন্য ডায়মন্ড প্যাকেজে লাগে ২৪ হাজার ৯৯৯ টাকা। গোল্ড আর ডায়মন্ডের সব তথ্য জানতে চাইলে প্লাটিনাম প্যাকেজের জন্য দিতে হবে ৩৪ হাজার ৯৯৯ টাকা। কেউ চাইলে তিনটি প্যাকেজ থেকে আলাদা করে তাঁর কোন কোন তথ্য প্রয়োজন, তা জানতে চাইতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও টাকার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।
পড়াশোনা শেষ করার পর একটু ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করতে চেয়েছিলাম। তখন মনে হলো, দুর্যোগসহ যা-ই ঘটুক, বিয়ে কিন্তু কখনো থেমে থাকে না। তাই ব্যবসাটাও সব সময় চালু রাখা সম্ভব হবে।মেজবাহ আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা, হুমায়রাডটকমডটবিডি
তথ্য পেতে এত বেশি টাকা কেন দিতে হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে মেজবাহ আহমেদ জানান, গোপনীয়তা রক্ষা করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে হয়। তথ্য সংগ্রহে ঝুঁকিও থাকে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ, যাতায়াত খরচসহ অন্যান্য খরচের জন্যও টাকাটা একটু বেশি নিতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ফরম পূরণ করে অথবা রাজধানীর বনশ্রীর অফিসে এসেও কেউ তথ্যগুলোর জন্য আবেদন করতে পারেন। ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তথ্য প্রতিবেদন আকারে দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি চালু করার আগে মেজবাহ আহমেদ একটি চাকরি করতেন। সেই চাকরি থেকে জমানো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসাটি শুরু করেছিলেন। বর্তমানে ১৫টি কম্পিউটারে কর্মীরা কাজ করছেন। শীতের সময় বিয়ের মৌসুমে মাসিক আয় চার লাখ টাকাও হয়। ১১ বেতনভুক্ত কর্মীর পাশাপাশি তথ্য যাচাইয়ে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ৬০ জন। রাজশাহীতে হাইটেক পার্কেও আরেকটি অফিস খোলার চিন্তাভাবনা চলছে। তবে করোনার সময় বিয়ের সংখ্যা বা আনুষ্ঠানিকতা কমে যাওয়ায় ব্যবসায় বেশ লোকসান হয়েছিল।
মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘এ ব্যবসাকে দাঁড় করানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্যবসার আয় দিয়েই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটিকে বড় করা হচ্ছে।’
তবে এ ব্যবসা শুরু করাটা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল বলে জানালেন মেজবাহ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে কেন এমন ব্যবসা করতে হবে, তা পরিবারও মানতে চায়নি। অন্যরাও হাসাহাসি করতেন। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। অনেক প্রবাসী বিয়ের চিন্তাভাবনা করে দেশে আসার আগেই বিয়ের জন্য তথ্য যাচাইসেবাসহ সংস্থার অন্যান্য সেবার জন্য বুকিং দিয়ে রাখছেন।
মেজবাহ আহমেদের নিজের বিয়ের বয়স সাড়ে চার বছর। সাড়ে তিন বছর বয়সী এক ছেলের বাবা তিনি। হাসতে হাসতে জানান, তাঁর বিয়ের আগে কনের তথ্য জানতে ‘গোয়েন্দাগিরির’ কাজটা তাঁর বাবা নিজেই করেছিলেন। তাই আর প্রতিষ্ঠান থেকে এ সেবা নেওয়ার সুযোগ হয়নি।
বর্তমানে হুমায়রা কোম্পানির এজেন্ট রয়েছে দেশের ৬৪ জেলায়। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আছে। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রতিনিধি আছে। হুমায়রা কোম্পানির তথ্য যাচাইসেবার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল শাফি।
মেজবাহ আহমেদ জানান, সিটি করপোরেশনে ‘ম্যারেজ প্ল্যানার’ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনের সুযোগ নেই। স্টার্টআপ হিসেবে ই-কমার্স ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) নিবন্ধনভুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।