যেখানে পানিতে আগুন জ্বলে সারা বছর
স্বচ্ছ জলরাশির ওপর দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। কাছে গেলে শুনতে পাওয়া যায় তীব্র শব্দ। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, পানির নিচ থেকে উঠছে বুদ্বুদ। অগভীর একটি কুণ্ডে (কূপ) আগুন জ্বললেও এর পানি একেবারে ঠান্ডা। পাহাড়ের টিলায় থাকা কুণ্ডটিতে সারা বছর আগুন জ্বলে। কিন্তু একদিনের জন্যও এ কুণ্ডের পানি শুকায়নি। বরং মাটি ভেদ করে বের হওয়া পানি উপচে পড়ছে পাশের ছড়ায়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডের পাহাড়ে এ কুণ্ডের অবস্থান। পাহাড়টির আশপাশের কোনো টিলায় পানি পাওয়া না গেলেও এ কুণ্ডে পানি থাকে সারা বছর। কবে থেকে এখানে আগুন জ্বলছে কেউ জানে না। এ নিয়ে রয়েছে অলৌকিক অনেক কাহিনি। তবে ভূতত্ত্ব গবেষকেরা বলছেন, মিথেন গ্যাসের কারণে সেখানে আগুন জ্বলছে। কিন্তু বছরের পর আগুন জ্বললেও পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় তা তোলা যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, চারদিকে সবুজ পাহাড়। মাঝের একটি টিলায় পুরোনো ভঙ্গুর দ্বিতল ভবনের ভেতরে ১০ বর্গফুটের একটি ছোট্ট কুণ্ড। কুণ্ডটিকে দুই ভাগ করা হয়েছে। দক্ষিণের অংশে আগুন জ্বলে। আগুনের তীব্রতাও রয়েছে। আগুনের তীব্রতায় মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, সে জন্য ইট-সিমেন্ট দিয়ে দেয়াল তোলা হয়েছে। যা দেখতে অনেকটা চুলার মতো। কুণ্ডটি স্থানীয় লোকজনের কাছে বাড়বানল নামে পরিচিত। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অগ্নিকুণ্ড মন্দির।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান। প্রতিবছর শিবচতুর্দশী তীর্থ উপলক্ষে লাখো পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে। সারা বছর আগুন জ্বলে বলে কুণ্ডটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই পর্যটকেরা সেখানে ভিড় করেন। অগ্নিকুণ্ডটির পাশেই রয়েছে অগ্নিকুণ্ড ঝরনা। ফলে ঝরনাপ্রেমীরা একই সঙ্গে ঝরনা ও অগ্নিকুণ্ড—দুটির দৃশ্যই উপভোগ করতে পারেন।
যে কারণে আগুন জ্বলে
বিজ্ঞানীদের মতে, মিথেন গ্যাসের কারণে সব সময় কূপটিতে আগুন জ্বলে। সেখানে বেশ কয়েকবার জরিপও হয়েছিল। কিন্তু উত্তোলন করার মতো গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) উপব্যবস্থাপক মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাড়বকুণ্ড এলাকায় একাধিকবার জরিপ হয়েছে। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের কোনো গ্যাস নেই। খুব সম্ভবত সেখানে পকেট গ্যাস রয়েছে। কম চাপসম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জ্বলছে। নয়তো অন্য কোথাও গ্যাসের মজুত আছে। যা ভূমির তল দিয়ে অনুভূমিক এসে ওই এলাকায় উল্লম্বভাবে বের হচ্ছে।
যেভাবে যাবেন
অগ্নিকুণ্ডে যেতে হলে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা থেকে যেকোনো বাসে বাড়বকুণ্ড বাজারে এসে নামতে হবে। এরপর বাজারের ভেতর দিয়ে পূর্ব দিকে রেললাইন পার হয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে হবে। আঁকাবাঁকা সড়কের কিছুদূর গেলেই পথের দুই ধারে চোখে পড়বে পেয়ারাবাগান। নিস্তব্ধ এ পাহাড়ে ভেসে আসে পাখির কিচিরমিচির। মনোমুগ্ধকর সড়ক ধরে দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে গেলেই পড়বে একটি তমালগাছ। গাছের নিচ থেকেই ছোট্ট টিলাতে অগ্নিকুণ্ড মন্দির দেখা যাবে। এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগেও সেখানে যাওয়া যাবে। এতে জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
যেহেতু অগ্নিকুণ্ডটি মন্দিরের ভেতরেই অবস্থিত, তাই প্রত্যেক পর্যটককে মন্দিরের পবিত্রতা বজায় রেখে জুতা খুলে সেখানে প্রবেশ করতে হয়। অগ্নিকুণ্ড মন্দিরে যাওয়ার পথে দর্শন করা যাবে শনি বাড়ি, বিষ্ণুমন্দির, জগন্নাথমন্দির, ত্রিনাথমন্দির, শিবমন্দির ও অন্নপূর্ণামন্দির। অগ্নিকুণ্ডের পাশেই বাড়বকুণ্ড বা বাসিকুণ্ড ও কালভৈরব মন্দির।
অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে মন্দিরের ভবনটি চুন–সুরকি ও সরু ইট দিয়ে নির্মিত। ছাদ নেই। নিচতলার বারান্দার ছাদ থেকে খসে পড়ছে ইট। সিঁড়ি ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। নিচতলায় অগ্নিকুণ্ডটির অবস্থান। বাড়বানলের এ অগ্নিকুণ্ডের নাম অনুসারে ইউনিয়নটির নাম হয়েছে বাড়বকুণ্ড। বিশ্বের বড় তথ্যকোষ উইকিপিডিয়া ও সরকারের জেলা প্রশাসনের ওয়েব সাইটেও বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
গত শনিবার সেখানে দেখা মেলে জনা বিশেক পর্যটকের। দলের একজন পুরান ঢাকার বাসিন্দা রিয়াদ হোসেন। তিনি অনলাইনে ব্যবসা করেন। তিনি জানালেন, ফেসবুকের একটি ট্যুর গ্রুপে এ অগ্নিকুণ্ডের একটি পোস্ট দেখেন। সেই থেকে এটি দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। তাই পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে চলে এলেন। শুক্রবার রাত ১১টায় বাসে ওঠেন। সকালে বাড়বকুণ্ড বাজারে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তারা হেঁটেই রওনা দেন অগ্নিকুণ্ডের দিকে।