চলতি বছরও শুরু হচ্ছে না ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্প

বিদ্যালয়ে খাবার দিলে শিশুশিক্ষার্থীরা অভুক্ত থাকবে না। পড়াশোনায় মনোযোগ হারাবে নাপ্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিস্কুট দেওয়া শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। উদ্দেশ্য ছিল, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা ও ঝরে পড়া ঠেকানো। মেয়াদ শেষ হওয়ায় দুই বছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ আছে। শিশুদের জন্য জরুরি এই প্রকল্প নতুন করে চালু করতে এর পর থেকে আলোচনা–পর্যালোচনা আর সংশোধন চলছে। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খাদ্য কর্মসূচি’ শীর্ষক নতুন স্কুল ফিডিং প্রকল্প চলতি বছরও শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগামী জানুয়ারিতে এ প্রকল্প শুরু হতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি) আওতায় এই স্কুল ফিডিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ‘দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুশিক্ষার্থীদের ৭৫ গ্রাম ফর্টিফাইড বিস্কুট (১০টি) দেওয়া হতো।

প্রকল্পটি শেষ হওয়ার বছরখানেক পর ২০২৩ সালের মে মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মাস দুয়েক পরই প্রকল্পটি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হবে।

তবে নতুন ডিপিপি তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত এর ওপর আলোচনা, মূল্যায়ন ও সংশোধন চলছে।

নতুন প্রকল্প আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। এটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে হবে। কারিগরি সহায়তা দেবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। শিক্ষক ও অভিভাবকদের পরামর্শে বিস্কুটের একঘেয়েমি কাটাতে ডিম, বিস্কুট, ইউএইচটি (আলট্রা হাই টেম্পারেচার) দুধ, পাউরুটি ও বিভিন্ন মৌসুমি ফল থাকবে ফিডিং প্রকল্পের খাবারে। সপ্তাহের পাঁচ দিন যেকোনো দুটি পদ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।

স্কুলে খাবার দিলে শিশুশিক্ষার্থীরা অভুক্ত থাকবে না। পড়াশোনায় মনোযোগ হারাবে না।
—আনোয়ারা খাতুন, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ২০২২ সাল পর্যন্ত স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় ছিল। ১০ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আনোয়ারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় শ্রমজীবী পরিবারের অনেক অভিভাবক ততটা সচেতন নন। তাঁরা অভুক্ত অবস্থায় শিশুদের স্কুলে পাঠিয়ে দেন। আবার কোনো কোনো পরিবারে তিন বেলা ভালোভাবে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। ওই পরিবারের শিশুরাও অভুক্ত অবস্থায় স্কুলে আসে।’

আনোয়ারা খাতুন আরও বলেন, ‘স্কুলে খাবার দিলে শিশুশিক্ষার্থীরা অভুক্ত থাকবে না। পড়াশোনায় মনোযোগ হারাবে না। এখন এমনও দেখা যায়, কোনো কোনো শিশু দুপুর হলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে চায়। আমরাও বুঝতে পারি, হয়তো কিছু না খেয়ে এসেছে, ক্ষুধার্ত। এ জন্য বাড়ি চলে যেতে চায়।’

প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের পর আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের খাবার দেওয়া শুরু করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
—আতাউল গণি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)।

দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৬ অনুসারে, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ছাত্রদের উপস্থিতির হার বেড়ে ৮৯ শতাংশ, ছাত্রীদের ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ঝরে পড়ার হার কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। এ প্রতিবেদন তৈরিতে ১৩টি জেলার প্রকল্পভুক্ত ৩১২টি বিদ্যালয়ের তথ্য নেওয়া হয়।

‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’ অনুসারে, প্রাক্‌-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার (ক্যালরি) ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসতে হবে বলে বলা আছে।

২০০১ সালে যশোরে প্রথমবার স্কুল ফিডিং প্রকল্প চালু করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটির সঙ্গে সরকার ২০১১ সালে যৌথভাবে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া ও টুঙ্গীপাড়া উপজেলায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প শুরু করে। ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। তবে কোভিডের সময় দীর্ঘ ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত চালানো হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২০ সালে মিড–ডে মিল (দুপুরের খাবার) প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ কাজের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শিখতে ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়।

নতুন প্রকল্পে খাবারে মাথাপিছু খরচ ২৮ টাকা

দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩৩ লাখ। তবে তিন বছর মেয়াদি নতুন প্রকল্পটি ৬২ জেলার ১৫০টি উপজেলায় বাস্তবায়ন হবে। ২১ হাজার ১৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৮০ শিক্ষার্থী এর আওতায় থাকবে।

নতুন প্রকল্প আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে হবে। ডিম, বিস্কুট, ইউএইচটি (আলট্রা হাই টেম্পারেচার) দুধ, পাউরুটি ও বিভিন্ন মৌসুমি ফল থাকবে ফিডিং প্রকল্পের খাবারে। সপ্তাহের পাঁচ দিন যেকোনো দুটি পদ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।

প্রকল্পটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে বলে গত ৭ জুলাই সিদ্ধান্ত হয়। আগে শুধু বিস্কুট দেওয়ায় শিশুপ্রতি খরচ হতো ১৮ থেকে ১৯ টাকা। নতুন প্রকল্পে খাবারের পরিমাণ বাড়ায় মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে ২৮ টাকার মতো। এর সঙ্গে আরও সাত টাকার মতো যোগ হবে খাবারপ্রক্রিয়া, পরিবহন ও সরবরাহের খরচ। প্রথম ছয় মাস শুধু বিস্কুট দেওয়া হবে। পরের আড়াই বছর দেওয়া হবে দুই পদ করে খাবার।

নতুন প্রকল্পের বিষয়ে এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছিল। পরে ২৩ জুন আরেকটি সভা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে অধিদপ্তরের প্রকল্প পর্যালোচনা সভা হয়। ২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় কমিয়ে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।

প্রকল্পের ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সভা বাবদ ভাতা, মুঠোফোন বিল, দায়িত্ব পালন ভাতা, খাবারের মান পরিদর্শন ব্যয় বাদ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও পানির বিল এবং ডাক খরচ কমানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য অতিরিক্ত এক হাজার টাকা ভাতাও বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় ডিজি পর্যায়ে দুই হাজার টাকা এবং প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় সচিব পর্যায়ে ৩ হাজার টাকা সম্মানি ভাতা থাকবে।

নতুন প্রকল্পের বিষয়ে এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছিল। পরে ২৩ জুন আরেকটি সভা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে অধিদপ্তরের প্রকল্প পর্যালোচনা সভা হয়।

কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে একই কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ওই ডিপিপি পাস হয়েছে। এ বছরই বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। ‘বাংলাদেশে প্রাক্‌–প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প’ শিরোনামে ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে ১ হাজার ৯৫টি স্কুলে। সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখের বেশি।

জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আতাউল গণি প্রথম আলোকে বলেন, দরিদ্র শিশুদের স্বাস্থ্য–পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধে স্কুল ফিডিং প্রকল্প জরুরি। তাই এ প্রকল্প নিয়ে অধিদপ্তর বসে নেই। বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে সময় বেশি লাগছে।...প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের পর আগামী জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীদের খাবার দেওয়া শুরু করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’