জুলাইয়েও বাদ যায়নি নারী-শিশু নির্যাতন

পরিস্থিতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করতে দেরি হয়েছে। থানায় পুলিশ সদস্য কম থাকা বা না থাকার কারণে সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

নারী-শিশু নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় গত ১৩ জুলাই পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী (৩১)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) তাঁকে ভর্তি করা হয় ১৭ জুলাই। স্বামীর হাতে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আরেক নারী ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ওসিসিতে আসেন ২৪ জুলাই।

সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুসারে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে উত্তাল জুলাই মাসেও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা থেমে ছিল না। পরিস্থিতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করতে দেরি হয়েছে। থানায় পুলিশ সদস্য কম থাকা বা না থাকার কারণে সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ মনোভাব না থাকায় জুলাই মাসের পরিস্থিতিতেও নারী ও শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে আক্রান্ত হয়েছে।
জিনাত আরা হক, প্রধান নির্বাহী, আমরাই পারি

বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৬টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সংকলিত করে জানিয়েছে, জুলাই মাসে ২৫৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্যাতনের শিকারের অর্ধেকই শিশু, ১২৪ জন। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে ৬২টি। এ ছাড়া ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ২টি এবং ধর্ষণচেষ্টার ২০টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, জুলাই মাসে ১১ ধরনের নির্যাতনে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে কল গ্রহণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩৭২টি।

কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয় ৫ জুন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।

আন্দোলন–বিক্ষোভের সময় পুলিশ মাঠে বেশি থাকায় থানায় অন্যান্য অভিযোগ গুরুত্ব পাচ্ছিল না। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়। নির্যাতনের বিষয়ে কল করেও ভুক্তভোগীরা সহায়তা পাচ্ছিলেন না। সরকারের পতনের দিন থেকে থানা আক্রান্ত হওয়া শুরু করলে পুলিশনির্ভর ৯৯৯ সেবায় পুরোপুরি ধস নামে। ১২ আগস্ট পর্যন্ত এ সেবা কার্যত বন্ধ ছিল।

ওসিসিতে গত ২৯ ও ৩০ জুলাই নবাবগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে ধর্ষণের শিকার দুই কিশোরীকে ভর্তি করা হয়। প্রতিবেশী ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এরপর ১ ও ৩ আগস্টও ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী ও শিশু ভর্তি হয়েছিল। এরপর টানা ছয় দিন কোনো ভুক্তভোগী আসতে পারেনি। ১০ আগস্ট থেকে আবার নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু ভুক্তভোগী ওসিসিতে ভর্তি হতে শুরু করে। থানায় কোনো পুলিশ সদস্য না থাকার সময়ে গত ৯ আগস্ট কেরানীগঞ্জে বাসায় নিয়ে জিম্মি করে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা খবর পেয়ে ওই তরুণীদের উদ্ধার করে ওসিসিতে পৌঁছে দেন।

জুলাই মাসে অনেক ভুক্তভোগী পরিস্থিতির কারণে ওসিসিতে আসতে পারেননি উল্লেখ করে ওসিসির আইন কর্মকর্তা তাহমিনা নাদিরা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ঘটনায় কয়েক দিন পর মামলা হয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ সেবা না পাওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯–এ কলের সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। তবে কল বাড়লেও প্রায় সারা দেশেই থানা-পুলিশ আক্রান্ত হওয়ায় সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। হেল্পলাইন ১০৯–এর তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছিল সাড়ে ৭৪ হাজার। জুলাই মাসে কল আসে ৮২ হাজারের বেশি।

নারী অধিকারবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘আমরাই পারি’র প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ মনোভাব না থাকায় জুলাই মাসের পরিস্থিতিতেও নারী ও শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির সুযোগে ‘রাজনৈতিক ইস্যু’ বানিয়েও ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখিয়েছেন অনেকে। এ ধরনের ঘটনায় ভয়ে অনেক পরিবার মেয়েদের বাড়ি থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জিনাত আরার মতে, নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করা এবং সমস্যা রয়েছে, তা স্বীকার করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।