যে খালের কারণে নোয়াখালীর দুই উপজেলার বন্যার পানি সরছে না

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ফেনী–নোয়াখালী সড়কের পাশের খালটিতে গজিয়েছে লম্বা লম্বার ঘাস। এই খালের পানির প্রবাহ না থাকায় বন্যার পানি আটকে আছে আশপাশের এলাকায়। গতকাল দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো।

কোথায়ও সবুজ নেপিয়ার ঘাস, কোথায়ও কচুগাছের জঙ্গল। আবার কোথায়ও কচুরিপানা। দেখলে মনে হবে ফসলের খেত। তবে খেত কিংবা চাষের জমির নয়, ফেনী-নোয়াখালী সড়কসংলগ্ন খাল এটি। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী থেকে পাশের সেনবাগ উপজেলার সেবারহাট এলাকা পর্যন্ত এই খালের বিস্তৃতি। খালটি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলার বড় একটি অংশের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। তাই এ নিয়ে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকার বাসিন্দারা।

সরেজমিনে খালের ১৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়ক ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালটির বেশির ভাগ অংশই ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে আছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বাজারের, আশপাশের বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা, পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্য। এসব কারণে খালটি দিয়ে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। পানি সরতে না পেরে খালের আশপাশের বাড়িসহ পাশের গ্রামগুলোর অনেক বাড়ি, সড়ক এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে।

খালটির চৌমুহনী থেকে সেবারহাট এলাকা পর্যন্ত অংশে সম্প্রতি বেগমগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ও রসুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রশিদের উদ্যোগে ময়লা অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু এলাকার কচুরিপানাসহ অন্যান্য বর্জ্য অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু চৌমুহনীর মদন মোহন উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে থেকে কালাপোল এলাকা পর্যন্ত খালের অপর অংশটিতে ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকায় পানি সরছে না। এতে জলাবদ্ধতার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না, মানুষজনের দুর্ভোগও কমছে না।

খালের আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাল দিয়ে পানির প্রবাহ ঠিক না থাকার কারণে আশপাশের গ্রামগুলোতে বন্যার পানি স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। এতে বন্যার ময়লা-আবর্জনা জমে থাকায় পানিগুলো দিন দিন দুর্গন্ধময়, নোংরা হয়ে উঠেছে। ফলে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, জ্বর, খোসপাঁচড়া, চুলকানিসহ পানিবাহিত নানা রোগ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন প্রতিদিনই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে বলে জানা যায়।

কথা হয় চৌমুহনী পৌরসভার হাজীপুর এলাকার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে পুরো খাল। অথচ এই খালে একসময় পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা ভিড়ত। মানুষ যাতায়াত করত। বর্ষা মৌসুমে খালে মাছ শিকারের ধুম পড়ত। এখন সবকিছুই অতীত। খালের পানি এখন দুর্গন্ধময়। বন্যার পানি এখন এই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। এতে এলাকায় ডায়রিয়া, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে যেসব ঘরের ভিটা পাকা নয়, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকার সড়কে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনায় একাকার বন্যার পানি মাড়িয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন গৃহিণী সালমা আক্তার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শুধু সড়কেই নয়, এখনো তাঁর বাড়িতে বন্যার পানি রয়ে গেছে। পানি জমে থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাড়িটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সালমা আক্তার বলেন, ১২ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। তিন দিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। ময়লা-আবর্জনার কারণে ঘরে ঢোকারও অবস্থাও নেই। অনেক কষ্টে ঘর খানিকটা পরিষ্কার করলেও বাইরে পা ফেলতেই ময়লা পানি। এতে কষ্টের শেষ নেই।

একই এলাকার আরেক বাসিন্দা মোস্তফা খান বলেন, খাল পরিষ্কার করে কী হবে? বড় জোর এক মাস, দুই মাস। এরপর আবার ব্যবসায়ী ও আশপাশের বাসাবাড়ির বাসিন্দারা ময়লা ফেলে তা ভরাট করে ফেলবেন। এসব বিষয়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং খালের পানির প্রবাহ ঠিক রাখার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। খালে ময়লা-আবর্জনা ফেললে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কঠোর হতে হবে। না হয় খাল পরিষ্কারের সুফল পাওয়া যাবে না।

বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চৌমুহনীর খালগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে ভরাট হয়ে গেছে। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানি নামছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে যত দূর সম্ভব খাল পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে এই দুর্যোগ থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পেতে হলে চৌমুহনী শহরের এবং আশপাশের খালগুলো খননের উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের রহমতখালী খালকেও খননের আওতায় আনতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, বেগমগঞ্জসহ আশপাশের উপজেলার পানি নামার যে মাধ্যম বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর খাল ও চৌমুহনী-সেনবাগ খাল, তা পুরোটা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। পরিষ্কারের পাশাপাশি ওই খালটি লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত পুরোটা খননের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে ওই খালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী অন্যান্য খালও সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।