মুক্তিযুদ্ধ
কিসিঞ্জারের সফর, ইন্দিরা-হাকসার সম্পর্কে টানাপোড়েন
একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।
১৯৭১ সালে একাধিক দিক থেকে জুলাই ছিল তাজউদ্দীনের জন্য অপেক্ষাকৃত সফল মাস। প্রথমত, ৪-৫ জুলাই ভারতের শিলিগুড়ি সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতির প্রতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দৃশ্যমান সমর্থন প্রকারান্তরে তাজউদ্দীনের বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তাদের আস্থাবোধ প্রকাশ করে।
আগে এ বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগ ঘটেনি। মন্ত্রিসভা যে সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে অবিচল, জনপ্রতিনিধিদের এই আস্থা দৃশ্যমান হয়।
দ্বিতীয়ত, জনপ্রতিনিধিদের সম্মেলনের পাঁচ দিন পর কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠকে সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ এবং অস্ত্রশস্ত্রপ্রাপ্তির ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নিঃসন্দেহে সেগুলো মুক্তিযুদ্ধের লক্ষে৵ বাংলাদেশ বাহিনীকে আগের তুলনায় সবল করে তোলে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারের কর্মপ্রচেষ্টার বাইরে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করে যেগুলো বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সংশ্লিষ্ট ভূরাজনৈতিক পরিসর সৃষ্টিতে সাহায্য করে, এর আগে যা ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জুলাই থেকে শিগগিরই উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে মাকি৴ন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের বহুমুখী কূটনৈতিক টানাপোড়েনের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
চতুর্থত, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের ভেতরে থেমে থাকা সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পর নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে। এই তিন মাসে বাংলাদেশের পুরোনো বিদ্রোহী সৈনিক এবং নতুন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা কারও হাতেই কার্যত কোনো অস্ত্র ছিল না। জুলাই থেকে ক্রমে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। প্রদেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পাকিস্তানবিরোধী সশস্ত্র তৎপরতার খবর আসতে শুরু করায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ স্পন্দন পুনরায় শুরু হয়।
পঞ্চমত, ২০ জুলাই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো তথা সব প্রধান মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়, যা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পথে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে মাকি৴ন প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের ভারত-পাকিস্তান-চীন
সফরের মধ্য দিয়ে। কিসিঞ্জার প্রথম দিল্লি আসেন ৬ জুলাই। সেখানে তিনি যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করতে, যাতে শরণার্থীদের অবিরাম স্রোত নিয়ে ক্রমর্ধমান উত্তেজনা পাকিস্তান ও ভারতের সরাসরি যুদ্ধে পরিণত না হয়। ভারত যে ইত্যবসরে বাংলাদেশের যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একের পর এক অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে এবং তাদের পরবর্তী তৎপরতা যে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের শঙ্কা ত্বরান্বিত করতে পারে, সে বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে ছিল।
এশিয়ার অভিমুখে যাত্রা শুরুর কিছু আগে ২১ জুন কিসিঞ্জার নিজেদের গোয়েন্দাসূত্রে জানতে পারেন যে জুন মাসে মস্কোতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংকে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা তৎপরতা চালানোর উদ্দেশে কিছু পুরোনো অস্ত্র সাহায্য করতে এবং চীনের সম্ভাব্য চাপ প্রতিহত করার জন্য ভারতকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়েছেন, যদি ভারত এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন জানায়।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, চীনের বিরুদ্ধে কোসিগিনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি যদি সত্যই দেওয়া হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের ব্যাপারে ভারত আরও কম প্রতিবন্ধকতা অনুভব করবে।’ (সূত্র: FRUS, ভলিউম ১১, দলিল ৮৭)। ভারত সরকার সত্যিই সে রকম চিন্তার বশবর্তী হয়ে অগ্রসর হচ্ছে কি না, তা অনুসন্ধান করা এবং তা মোকাবিলা করার মতো পথ খুঁজে পাওয়াও ছিল কিসিঞ্জারের ভারত সফরের অন্যতম লক্ষ্য।
হাকসারের সঙ্গে প্রথম বৈঠক
৬ জুলাই অপরাহ্ণে দিল্লি পৌঁছেই কিসিঞ্জার প্রথম দেখা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষস্থানীয় নীতি উপদেষ্টা পি এন হাকসারের সঙ্গে, তাঁর ‘সাউথ ব্লকের’ অফিসে। তিনি হাকসারের ধারণা জানতে চান, কবে নাগাদ শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে? জবাবে হাকসার বলেন, শরণার্থীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং তারা যেভাবে হত্যা ও নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করে কেবল প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তারপর সেখানে তাদের ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই; ভারত সরকারও বল প্রয়োগে তাদের ফেরত পাঠাতে পারছে না, কেননা তা হবে তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। হাকসার বলেন, এর ফলে ভারতে এমন এক উগ্র সাম্প্রদায়িক অভিমত গড়ে উঠছে, যার ফলে এ দেশের অসাম্প্রদায়িক সামাজিক ভিত্তি ভেঙে পড়তে পারে।
তিনি জানান, তাঁদের অভিমত হলো পূর্ব পাকিস্তানে যদি একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সরকার যদি অসাম্প্রদায়িকতার পথ অনুসরণ করে তবে ধর্মমতনিবি৴শেষে সব শরণার্থী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবে। কাজেই হাকসার বলেন, এই বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য ভারত দ্রুত এই সংকটের সমাধান চায়।
কিসিঞ্জারও যুক্তি দেন, ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করার ফলে পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তাতে এই সংকটের কোনো সমাধানও সম্ভব নয়। এ অভিযোগ সামাল দিতে হাকসার বলেন, ভারত এ পর্যন্ত কোনো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্য করেনি, অস্ত্র যা আনার তা তারা নিজেরাই পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে এনেছে এবং সেগুলো নিয়ে সুবিস্তৃত, অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার পর তা তারা ব্যবহার করে চলেছে, যা সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।
কথাটি সম্পূর্ণ অসত্য নয়। তখন পর্যন্ত ভারতীয় মার্কা–সংবলিত অস্ত্র সরবরাহ করার জটিলতা অতিক্রম করতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তাদের অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষেই ছিল সামান্য। কিন্তু তারা যে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে চলেছে, তা গোপন করা সম্ভব ছিল না।
মে মাস থেকে সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং কার্যক্রমের প্রসার এবং ট্রেনিং শেষে তাদের অস্ত্র সরবরাহ করার সমস্যা পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারির অধীন। কিন্তু এ নিয়ে অতটা উৎকণ্ঠাও তাদের তেমন ছিল না।
মাকি৴ন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার একাংশের অভিমত ছিল পাকিস্তানের আগ্রাসী নীতির জবাবে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রয়োজন হিসেবে ভারতকে হয়তো এমন কিছু করার প্রয়োজন হয়েছে।
কিন্তু জুলাই মাসের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্যবহৃত পুরোনো অস্ত্র প্রদানে তৎকালীন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন কথিত সম্মতি সম্ভবত কিসিঞ্জারের উদ্বেগকে বহুলাংশে বাড়িয়ে তোলে।
শরণার্থীস্রোত প্রশমন এবং বিদ্রোহী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা যায়, সে অন্বেষণ তাঁর জন্য মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। পি এন হাকসারের সঙ্গে পারস্পরিক অভিযোগের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে কিসিঞ্জাদের সেই সমাধানের অন্বেষণ কতটুকু সম্ভব হয়েছিল, তা স্পষ্ট ছিল না।
ইন্দিরা-হাকসার চিন্তার ভিন্নতা
উদ্ভূত সমস্যার মূল নির্যাসটুকু পি এন হাকসার কিছুটা রহস্যাবৃতভাবে হলেও কিসিঞ্জারকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, ভারত সরকার ‘যুদ্ধে যেতে চায় না, কিন্তু কীভাবে যুদ্ধে না গিয়ে পারা যাবে তা–ও জানে না।’ ওই ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যটিই সম্ভবত ছিল বাংলাদেশ সংকটের নিষ্পত্তি নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী অংশে অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী ও পি এন হাকসারের মধ্যে—গৃহীতব্য পলিসি নিয়ে গভীর মতদ্বৈধতার সংক্ষিপ্তসার।
এ বিতকে৴র বিষয় স্পষ্টভাবে অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কি না, আমার অজানা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অভিমত ছিল কোনো যুদ্ধবিগ্রহের পথে না গিয়ে কারও মধ্যস্থতায় এই সংকটের নিষ্পত্তি করা।
স্বভাবতই এই অভিমত বহাল হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার অধিকারী পি এন হাকসার মনে করতেন, পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তান সামরিকভাবে পরাজিত এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব বাংলার ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের কারোরই মধ্যস্থতায় ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।
ইন্দিরা গান্ধী ও পি এন হাকসারের পারস্পরিক সম্পর্ক এত দীর্ঘদিনের এবং প্রায়ই তা এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল যে তাঁদের এই গভীর মতবিরোধ প্রকাশ না করে সবার অগোচরে হাকসার প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে কম৴ভারে তিনি অতিশয় ক্লান্ত, মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সংকটের ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। সর্বোপরি তাঁর বয়স ৫৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী তিনি সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর নিতে চান। ঘটনাটি ঘটে সম্ভবত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে—কিসিঞ্জারের দিল্লি সফর শুরু হওয়ার প্রাক্কালে।
ইন্দিরা গান্ধী ও পি এন হাকসার ছিলেন বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে একে অপরের পরিচিত। লন্ডনে ছাত্র অবস্থায় তাঁরা দুজনই ছিলেন বামপন্থী কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া লিগ’ সংগঠনে কমবেশি সক্রিয়। হাকসার ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রজনী পাম দত্তের ঘনিষ্ঠ।
চল্লিশের দশকের শুরুতে ভারতে ফিরেও হাকসার দুই বছর ভোপালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তারপর মতভিন্নতার কারণে পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী বরাবরই ছিলেন ‘মধ্যপন্থী’। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতালাভের পর তাঁর পিতা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পরামর্শে হাকসার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন।
‘পারিবারিক হিতৈষী’ হিসেবে পরিগণিত হাকসারকে ১৯৬৭ সালে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিয়োগ দেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সচিব’ হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রিসভার প্রবীণ ও দক্ষিণপন্থী ‘সিন্ডিকেট’ যাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব ব্যর্থ করার কাজে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের প্রতিহত করা।
গণমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি ও সক্রিয় সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে হাকসার ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকে সংহত করে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চে ভারতে যে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস তাতে বিপুল ভোটে জয়ী হয়।
কিন্তু অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনিচ্ছুক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অমানুষিক বর্বর অভিযান। ফলে সেখান থেকে ভারত অভিমুখে শুরু হয় ভীতসন্ত্রস্ত শরণার্থীর বিরামহীন জনস্রোত।
এই অভাবিত উদ্বাস্তুস্রোত বন্ধ করা স্বল্প সময়ের মধ্যে শরণার্থীদের স্বদেশ ফেরত পাঠানোর উপায় উদ্ভাবনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন হাকসার এবং ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংগঠনের প্রধান রামনাথ কাওকে। কাও চল্লিশের দশক থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তরে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৬২ সালে ভারত-চীন সীমান্ত যুদ্ধের অব্যবহিত পর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শ ও সহায়তায় কাও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে এক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন, যার পরিবর্তিত নাম হয় ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং; সংক্ষিপ্ত নাম ছিল আরএডব্লিউ (র), আরও পরে তা পরিচিত হয় রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস হিসেবে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক আপস-নিষ্পত্তি সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকায় আওয়ামী লীগের শীর্ষতম নেতৃত্বের সঙ্গে এই সংস্থাটির সংশ্লিষ্টতা বেড়ে ওঠে।
এর বিস্তারিত বিবরণ এখনো অনেকখানি অজ্ঞাত। তবে পাকিস্তানের গণহত্যা শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কলকাতায় ‘র’–এর নিজস্ব ভবনে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতৃত্বের একাংশ দ্রুত তাদের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়।
এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে শরণার্থীস্রোত দ্রুত বেড়ে ওঠার পটভূমিতে ভারতে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার গড়ে ওঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই যুব সংগঠন যুক্ত থাকেনি। এদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, এরা বাংলাদেশ সরকারের অনুগত নয় এবং এদের স্বতন্ত্র কমান্ড ব্যবস্থা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক সমর্থিত।
এরা নিজেদের অভিহিত করে ‘মুজিব বাহিনী’ হিসেবে। মে মাসে তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম দেরাদুনের অদূরে চাকবাতায় ‘র’–এর ট্রেনিং ঘাঁটিতে শুরু হওয়ার সংবাদ এদের সূত্রেই প্রকাশ পায়। এসব দাবি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়নি।
বস্তুত প্রথম থেকেই বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ও সহায়তা করার কার্যক্রম প্রায় নির্দ্বিধায় শুরু করলেও ভারত সরকার তাদের সহায়তা কার্যক্রমে এক দ্বৈত ব্যবস্থাপনার নীতি অনুসরণ করতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিদে৴শে কেন ও কীভাবে এই দ্বৈত ব্যবস্থাপনার উদ্ভব ঘটেছিল, তা ভারত সরকারের গোপন দলিলপত্র থেকে এখনো উন্মোচিত হয়নি।
এ বিষয়ে আমার সীমিত জ্ঞানের কিছু অংশ আমি বণ৴না করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন গ্রন্থের (প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯) ১৩৫ পৃষ্ঠায়। ২০০১ সালে রেকর্ড করা সে বিবরণের বাইরে ভিন্ন কোনো সাক্ষ্য বা তথ্য আমার নজরে পড়েনি।