এবারের গণিত উৎসবে অংশ নিতে সারা দেশ থেকে প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘অনলাইন বাছাই অলিম্পিয়াড’। নির্বাচিতদের নিয়ে ১৮টি শহরে হয় ‘আঞ্চলিক গণিত উৎসব’। আঞ্চলিকের বিজয়ীরা জড়ো হয়েছিল রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল প্রাঙ্গণে। পরীক্ষার পাশাপাশি নানা আয়োজনে শিক্ষার্থীরা মেতে ছিল। শেষে চূড়ান্ত হয় জাতীয় গণিত উৎসবের ৮৫ বিজয়ী।
‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব ২০২৪’-এর দুই দিনব্যাপী জাতীয় পর্বের সমাপনী ছিল আজ শনিবার। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী ১ হাজার ৩৫০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়৷ ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগান সামনে রেখে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি ২২তম বারের মতো এ উৎসবের আয়োজন করে।
সমাপনী দিনের আয়োজন শুরু হয় মেরিল বেবি–প্রথম আলো বর্ণমেলায় ‘দেশের গানে মাতিয়ে দাও’ প্রতিযোগিতার বিজয়ী সাত শিশুশিল্পীর জাতীয় সংগীত ও অমর একুশের গানের মধ্য দিয়ে। এরপর শুরু হয় রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। গতকাল শুক্রবার বাছাইপর্ব থেকে আসা প্রতিযোগীরা এতে অংশ নেয়। পর্দায় দেখানো হয় চমক হাসানের লেখা ‘মন মেলে শোন শুনতে পাবি বিজয়ের আহ্বান’—গণিত উৎসবের গানের ভিডিও।
থিয়েটার কোরিওগ্রাফির দল ‘কাদামাটি’ পরিবেশন করে দেশাত্মবোধক পরিবেশনা। মুখ দিয়ে নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ করে বিটবক্সিং করে শোনান ‘বিটমসফিয়ার’-এর সদস্যরা। ‘গণিতের পট’ নিয়ে মঞ্চে আসেন খুলনার ‘রূপান্তর থিয়েটার’–এর শিল্পীরা৷ শিক্ষার্থীদের ‘মাদক’, ‘মিথ্যা’ ও ‘মুখস্থ’—এই তিনটিকে ‘না’ বলান বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। অনুষ্ঠানে দেশের গণিত অলিম্পিয়াডের প্রয়াত পথিকৃৎদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
চলতি বছর বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়েছে। অনুষ্ঠানে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন অভিভাবক আয়োজন নিয়ে তাঁদের পরামর্শ ও মতামত তুলে ধরেন। এই পর্ব সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর জাহিদ হোসাইন খান।
এক মিনিট পর্বে অতিথিরা
‘এক মিনিট পর্বে’ বিশিষ্ট অতিথিরা এক মিনিটে তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষার্থীদের গণিতের জটিল সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। যেসব সমস্যা গণিতের রথি–মহারথিরাও সমাধান করতে পারেনি। এসব সমস্যার সমাধান না করতে পারলেও এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটবে।
এই শিক্ষার্থীরা দেশকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে বলে মনে করেন সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস। তিনি বলেন, আন্দোলন–সংগ্রামের মাধ্যমে পাওয়া বাংলাদেশকে শিক্ষার্থীরা মেধা দিয়ে এগিয়ে নেবে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহিদুর রহমান খান বলেন, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এখন থেকেই গড়ে উঠতে হবে। দেশ কীভাবে উপকৃত হবে, দেশের মানুষের মঙ্গল হবে, সেটাও ভাবতে হবে। বাংলাদেশের এই তরুণ শিক্ষার্থীরা বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হবে—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা বলেন, জীবনের সব ক্ষেত্রে বিজয়ী মনোভাব নিয়ে চলতে হবে। শিক্ষিত মানুষ অনেক আছে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে।
গণিত মানুষের মন, চিন্তা–চেতনাকে সমৃদ্ধ করে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, যেসব শিক্ষার্থী গণিত নিয়ে চর্চা করেছে, তারা এখন ভালো অবস্থানে আছে। গণিতের চর্চা শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার দেব বলেন, গণিত শিখলে স্বপ্ন দেখতে পারবে। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক প্রশিক্ষক রাজিয়া বেগম বলেন, তোমরা যত স্বপ্ন দেখবে তত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া বাস্তব হবে।
টালিখাতার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত খান বলেন, ‘ভয়ংকর শব্দটা শুনলে মনে হয় অঙ্কের ভয়। তাই আমরা বলি, জয়ংকরের জয় হোক। অঙ্কের ভয়কে জয় করাই জয়ংকর।’
এই আয়োজনে যারা অংশ নিয়েছে, তারা সবাই বিজয়ী বলে মনে করেন বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক রিজওয়ানা রিয়াজ। তিনি বলেন, এই শিক্ষার্থীরা গণিতের ভয়কে জয় করেছে। রিভ সিস্টেমসের পরিচালক আজমত ইকবাল বলেন, ‘একসময় আমরা ভাবতাম বুয়েট আমাদের সর্বোচ্চ সীমা। এখন হার্ভার্ড, এমআইটির মতো দুনিয়াখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে।’
‘এক মিনিট পর্বে’ সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সকাল রায়।
বিজয়ী হলো যারা
৮৫ জনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সনদ, ক্রেস্ট, মেডেল ও টি-শার্ট। এবারের আসরে প্রাইমারি ও জুনিয়র ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়নস অব দ্য অলিম্পিয়াড বরিশাল জিলা স্কুলের আরিফ মাহবুব পেয়েছে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার এবং সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়নস অব দ্য অলিম্পিয়াড জামাল নজরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে ঢাকা কলেজের এস এম এ নাহিয়ান।
চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস হয়েছে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের নাবি হোসেন, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে বরিশাল জিলা স্কুলের আরিফ মাহবুব, সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের নাফিস নুর তাসিন এবং হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে ঢাকা কলেজের এস এম এ নাহিয়ান।
এ ছাড়া জেবুন্নেসা হাশেম পুরস্কার পেয়েছে স্কলাসটিকার বারিরাহ মোস্তাখার, প্রকৌশলী লুৎফর রহমান স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে বাকলিয়া সরকারি কলেজের জিতেন্দ্র বড়ুয়া, খোদাদাদ খান স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে স্কলাসটিকার ওয়াফি মারজুক মোহাম্মদ, গৌরাঙ্গ দেব রায় স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে চট্টগ্রাম কলিজিয়েট স্কুলের রায়হান সিদ্দিকী, সজল–কাজল স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে কুমিল্লা জিলা স্কুলের তানজিম কামাল, আবিদ রেজা স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে গ্লিনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাকিন আল সাদাফ এবং এম সেকেন্দার আলি স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের আবরার জাহিন পাঠান।
জামিলুর রেজা চৌধুরী নান্দনিক সমাধান পুরস্কার পেয়েছে সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে সিলেট ক্যাডেট কলেজের আহনাফ তাহমিদ জাহিন। নম্বর মেলানোর খেলা সুডোকু প্রতিযোগিতায় জয়ী হয় নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের সাদমান শাহরিয়ার সোহান। মাত্র ৮ দশমিক ৫০ সেকেন্ডে রুবিকস কিউব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষার্থী মুনতাজিম বিল্লাহ। সেরা গণিত ক্লাবের সম্মান পেয়েছে রাঙামাটির ক্রিয়েটিভ সায়েন্স সোসাইটি। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরার হাতে ভেন্যু স্মারক তুলে দেওয়া হয়।
এবার আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের বাথ শহরে অনুষ্ঠেয় ৬৫তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দল নির্বাচন করা হবে।
পুরস্কার পাওয়ার পর প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস হওয়া নাবি হোসেন ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। নাবির মা নূর আফরোজা জাহান বলেন, ‘এমন আয়োজন শিশুদের গণিতের প্রতি যেমন উৎসাহী করছে, তেমন সুস্থ প্রতিযোগিতাও শেখাচ্ছে। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে অনেক কাজে লাগবে এই অভিজ্ঞতা।’