লুটপাট-দখলদারত্ব বন্ধ না হলে নতুন নতুন শামীম ওসমান তৈরি হবে

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার সাড়ে ১১ বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বরছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

লুটপাট, দখলের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানের মতো মানুষের উত্থান হয়েছে। যাঁর বিরুদ্ধে ত্বকী হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও সেই দখলদারত্ব দেখা যাচ্ছে। এসব বন্ধ না হলে নতুন নতুন শামীম ওসমান তৈরি হবে। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাইকারি হারে মামলা দেওয়া বন্ধ না হলে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হবে।

আজ শনিবার রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার সাড়ে ১১ বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা উঠে আসে। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের উদ্যোগে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শামীম ওসমানদের জন্ম হয় লুটপাট-দখলদারত্ব থেকে। এগুলো যদি বন্ধ না হয়, তাহলে নতুন নতুন শামীম ওসমান তৈরি হবে। তিনি বলেন, জনগণের হাতে যেন ক্ষমতা থাকে। আর বিগত সরকারের পুরোনো চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ সময় তিনি মোসারাত জাহান মুনিয়া, তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী, সোহাগী জাহান তনু এবং সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত করার আহ্বান জানান।

নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র আইভি রহমান ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, শেখ হাসিনা কিংবা শামীম ওসমানের মতো মানুষের সঙ্গে যদি এভাবে পাইকারি হারে মামলা দেওয়া হয়, তাহলে পুরো বিচার বা মামলার প্রক্রিয়া নিয়েই মানুষের মধ্যে সংশয় বা সন্দেহ তৈরি হবে। গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকারের এখানে মনোযোগ থাকা দরকার। তিনি আরও বলেন, সালমান এফ রহমান, যিনি ব্যাংক লুটপাট করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যদি এমন মামলা হয়, যা টিকবেই না! কিন্তু তাঁর অপরাধ পাহাড়সমান। যে মামলা হচ্ছে, তা তো তাঁকে রক্ষা করার ব্যবস্থা!

ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, আর যেন কোনো শামীম ওসমান তৈরি না হয়। ওসমান পরিবারের রাজত্ব দখলে লিপ্ত কিছু রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার ভেতর থেকে না হলে এই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

‘ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার সাড়ে ১১ বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের উদ্যোগে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে ধারণাপত্র পাঠ করেন রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, ত্বকী হত্যার পর দীর্ঘ সাড়ে ১১ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রান্তে বিচারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হয়েছে। তিনি পরিবর্তিত এই সময়ে ত্বকী হত্যার বিচার পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।

রফিউর রাব্বি বলেন, বিচারের দাবিকে স্তব্ধ করার জন্য সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তাঁদের ওপির বিভিন্নভাবে হামলা, নির্যাতন চালিয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নাম ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে আসার পরও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ত্বকীর বাবা বলেন, তাঁর ছেলেকে হত্যার নির্দেশদাতা শামীম ওসমান। ত্বকী হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের পুলিশ প্রশাসন সুরক্ষা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ত্বকী হত্যার তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ত্বকী হত্যা একটি দেশব্যবস্থার প্রতীক। দেশব্যাপী সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল। ত্বকী হত্যা হোক বা জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের দমাতে হত্যাকাণ্ড হোক, সবই ছিল ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে।

বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হলে বলতে হবে, আগুন দিয়ে আগুন নেভানো যায় না। এখন যা হচ্ছে, তা প্রতিদ্বন্দ্বিতা; লুটপাটের ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা চাই না।’

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান বলেন, মানুষের মধ্যে বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আগের ঘটনাগুলো দিয়ে বিচার শুরু হলে মানুষের মধ্যে এ আস্থা ফিরবে যে সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তারা প্রতিহিংসার পথে চলবে না।

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান বলেন, গত ১৫ বছরে বিচারহীনতাই ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ত্বকী হত্যার বিচারের পথের বাধা দূর হয়েছে, এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই সরকার যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।

বিচার পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার উল্লেখ করে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, খুনিদের রক্ষা করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই সরকার যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ত্বকীসহ তনু, সাগর-রুনি হত্যার বিচার করবে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণফোরামের নেতা সুব্রত চৌধুরী, ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ।