খালা থেকে ‘মা’ হওয়া রুখসাতের সংসারজীবনের এক বছর
করোনাভাইরাস অনেকের জীবন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয় নিয়ে আসে বহু পরিবারে। এমনই একটি পরিবার একাত্তর টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রযোজক নাজমুল ইসলামের। তাঁর স্ত্রী রিফাত সুলতানা ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে মেয়ে হৃদিতাকে জন্ম দিয়ে বিকেলে মারা যান। সে সময় এই দম্পতির ছিল তিন বছর বয়সী আরও দুই যমজ সন্তান ধ্রুব ও রুদ্র। তখন মা হারা ছোট্ট এই তিন শিশুকে বুকে আগলে নেন তাদের খালা রুখসাত সুলতানা। দুই বছর মায়ের আদরে তাদেরকে লালন–পালন করার পর গত বছর ২৩ জুন নাজমুল ইসলামকে বিয়ে করে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই শিশুদের ‘মা’ হয়ে ওঠেন রুখসাত। আজ রোববার নাজমুল–রুখসাতের বিয়ের প্রথম বার্ষিকী।
নাজমুল জানান, বিবাহবার্ষিকীর দিনটিতে অফিস শেষ করে রুখসাত সুলতানাকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে প্রথম স্ত্রী রিফাতের কবর জিয়ারত করতে যাবেন। তিনি বলেন, রিফাতকে ভুলে থাকার কোনো উপায় নেই। তাঁর তিন সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছেন তাঁর বোন রুখসাত।
রুখসাত সুলতানার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন নাজমুল। বললেন, ‘চাঁদনীর (রুখসাত) জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু সে তাঁর সব শখ-আহ্লাদ বাদ দিয়ে আমার আর রিফাতের তিন সন্তানকে মায়ের মমতায় বড় করছে। আইনজীবী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারও সেভাবে করতে পারছে না সন্তানদের জন্য। ছেলে-মেয়েদের সব আব্দার তো চাঁদনীকেই মেটাতে হচ্ছে। ছেলেরা নার্সারিতে পড়ছে। মেয়েকে সামনে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। এসব সব সামলাতে হচ্ছে।’
রিফাত সুলতানা ছিলেন একাত্তর টেলিভিশনের সহকারী প্রযোজক। করোনায় নাজমুল শুধু স্ত্রী রিফাত সুলতানাকে নয়, কাছাকাছি সময়ে মা (২০২১ সালের ৩ মে) ও বাবাকেও (২০২১ সালের ৬ মে) হারিয়েছিলেন। নাজমুল শাশুড়িকে স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত দিতে পারেননি। শুধু মেয়ের ছবি দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে মা আর বাবা একই হাসপাতালের আইসিইউতে পাশাপাশি বিছানায় ছিলেন। মা যেদিন মারা যান, সেদিন নাজমুলের বাবার জ্ঞান ছিল না। তাই মা মারা গেছেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তারপর বাবাও মারা যান। রিফাত সুলতানা মারা যাওয়ার পর হৃদিতার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতে ১৮ দিন লেগেছিল।
করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি বর্তমানে আর নেই। তবে নাজমুল ও রিফাত সুলতানার স্বজনেরা পদে পদে করোনার ভয়াবহতা টের পাচ্ছেন। তাঁরা চাইলেও তা ভুলতে পারেন না। রিফাত সুলতানা মারা যাওয়ার পর নিজের সিদ্ধান্তেই বোনের তিন সন্তানকে মায়ের আদরে বড় করার জন্য রুখসাত সুলতানা ভগ্নিপতি নাজমুল ইসলামকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রিফাত সুলতানা বেঁচে থাকতেই তাঁর যমজ ছেলেরা রুখসাতকে ‘আম্মু’ ডাকত। আর হৃদিতাতো জন্মের পর থেকেই আম্মু হিসেবে রুখসাতকেই চেনে।
নাজমুল ইসলাম বললেন, ‘বনশ্রীতে আমার বাসায় ঢোকার মুখেই ছবির গ্যালারি করেছি। তাতে রিফাত আর আমার বিয়ের ছবি, রুখসাতের সঙ্গে বিয়ের ছবি, আমার বাবা ও মায়ের ছবি, ছেলে– মেয়েদের ছবি দিয়ে সাজিয়েছি। ছেলেদের তাদের মাম্মাম (রিফাত) এর কথা মনে আছে। আর মেয়ে জানে মাম্মাম বলতে একজন ছিলেন। এভাবেই তারা বড় হচ্ছে।’
২০২১ সালে রিফাত মারা যাওয়ার পর বোনের তিন সন্তানকে মায়ের মমতা দিয়ে বড় করছিলেন রুখসাত সুলতানা। সে সময় মা হারানো এই তিন শিশুর সহায় হয়ে ওঠেন তাদের এই খালা। দুই বছরের বেশি সময় মায়ের অভাব পূরণকারী রুখসাত গত বছর ২৩ জুন নাজমুল ইসলামকে বিয়ে করে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তিন শিশুর মায়ের আসনে বসেন।
গত বছর বিয়ের দিন রুখসাত সুলতানা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আপু মারা যাওয়ার সময় তাঁর তিন সন্তানকে আমার হাতেই তুলে দিয়েছিল। ধ্রুব আর রুদ্র আপু থাকতেই আমাকে আম্মু ডাকত। এখন অফিশিয়ালি আমি ওদের তিনজনের মা হলাম। ওদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমরা সিদ্ধান্তটা নিলাম।’ তবে দুই পরিবারের বড়রা কেউ এ দায়িত্ব নিতে চাপ দেননি, নিজের ইচ্ছাতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানিয়েছিলেন রুখসাত সুলতানা। মূলত বোন রিফাতকে হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই রুখসাত খালা থেকে মা হয়ে গিয়েছিলেন বা পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করেছিল।
রিফাত তাঁর অনাগত সন্তানকে টুকি ডাকতেন। এই টুকিই এখন হৃদিতা। তার জন্মের পর থেকে রুখসাতের বুকের ওমেই বড় হয়েছে ও। আর রিফাত মারা যাওয়ার পর যমজ দুই ছেলের ‘মাম্মাম আসে না কেন, কবে আসবে’-এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি সব ঝড়ঝাপটাও তাঁকে সামলাতে হয়েছে।
নাজমুল ইসলাম জানালেন, রুখসাত সুলতানাকে বিয়ে করার পর বেশির ভাগ মানুষই শুভকামনা জানিয়েছেন ফেসবুকে। তবে কেউ কেউ বাজে মন্তব্যও করেছেন। তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাদের একটু ভালো রাখার জন্য, মায়ের অভাব যাতে কোনো দিন বুঝতে না পারে সেই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য এই দম্পতি বাজে মন্তব্যগুলোও হজম করেছেন।
বিবাহ বার্ষিকীতে নাজমুল ইসলাম তাঁর ফেসবুকে রুখসাতের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘হাল ছাড়া নৌকার মতো আমাদের জীবনকে তুমি আবারও মায়া দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে গুছিয়ে এনেছ। আগলে রেখেছ। নতুন পথ চলার বর্ষপূতির এই দিনে তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাশে থেকো।’