সর্বজনীন পেনশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে মন্ত্রীর বৈঠকের ‘খবর নেই’ 

টানা এক সপ্তাহ ধরে অচল হয়ে রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই পরিস্থিতি বেশি দিন চললে সেশনজটের আশঙ্কা। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পেনশনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেনফাইল ছবি: প্রথম আলো

শ্রেণিকক্ষ ও বিভাগীয় অফিসগুলোতে তালা ঝুলছে। ফলে সেখানে নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী। ক্লাস ছেড়ে শিক্ষকেরা কলাভবনের মূল ফটকের প্রবেশমুখে বসে অবস্থান নিয়ে নিজেদের দাবির পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন।

এ চিত্র গতকাল রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের। অন্যান্য একাডেমিক ভবনেও একই চিত্র। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় টানা এক সপ্তাহ ধরে অচল হয়ে রয়েছে। কিন্তু সংকট সমাধানে এখনো সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ রেখে আগের মতোই পেনশন–ব্যবস্থা চালু রাখাসহ তিন দফা দাবিতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। শিক্ষকদের অন্য দুটি দাবি হলো সুপার গ্রেডে (জ্যেষ্ঠ সচিবেরা যে গ্রেডে বেতন পান) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো।

তাঁদের সঙ্গে কখন বসব, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। সময়মতো সমাধান হবে
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

১ জুলাই শুরু হওয়া এই কর্মবিরতির মাঝে গত দুই দিন (শুক্র ও শনি) সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে গতকাল রোববার থেকে আবার কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শিক্ষকদের এই কর্মসূচির কারণে ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে না। এ রকম পরিস্থিতি বেশি দিন চললে শিক্ষার পুরোনো ‘ব্যাধি’ সেশনজট আবার তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত আলোচনার কোনো খবর নেই। আলোচনার টেবিলে বসতে পারলে, আমাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারলে সরকার তা মেনে নেবে। 
নিজামুল হক ভূঁইয়া, মহাসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন

শিক্ষকদের এই আন্দোলনের প্রথম দিকে তাঁদের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনার একটি কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এ ব্যাপারে গতকাল পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত আলোচনার কোনো খবর নেই। তবে তিনি আশা করছেন, আলোচনার টেবিলে বসতে পারলে, তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারলে সরকার তা মেনে নেবে।

আরও পড়ুন

নিজামুল হক ভূঁইয়া আরও বলেন, তিন দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এর আগে গত বুধবার নিজামুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। অবশ্য পরদিন আবার তিনি জানান, মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যস্ত থাকায় আলোচনায় বসতে পারেননি। তবে শিগগির বসবেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সর্বজনীন পেনশনে প্রত্যয় কর্মসূচির বিরুদ্ধে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমাধান হয়ে যাবে। শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে কখন বসব, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। সময়মতো সমাধান হবে।’ 

এখন প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নাকি এর মধ্যেই শিক্ষকদের সঙ্গে সরকার উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হতে পারে, সে ব্যাপারে ওই মন্ত্রীরা স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। 

‘কোনোভাবেই পিছু হটবেন না’

কর্মবিরতির পাশাপাশি গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে শিক্ষকেরা অবস্থান নেন। সেখানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। কলাভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক সংহতি জানান। বক্তাদের তাঁদের সবার কণ্ঠে ছিল দাবি আদায়ের কঠোর সুর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, তাঁদের তিন দফা দাবির বিষয়ে সামান্য ছাড় হবে না। দাবি আদায়ে আন্দোলন চলবে।

দাবি আদায়ে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা। তিনি বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, চালিয়ে যাবেন। এই আন্দোলন থেকে কোনোভাবেই পিছু হটবেন না। 

আরও পড়ুন

সরকারও এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের দাবিতে ছাড় না দেওয়ার অবস্থানে রয়েছে। একই সঙ্গে একাধিক মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চিন্তা রয়েছে সরকারের। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার চীন সফরে যাচ্ছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নাকি এর মধ্যেই শিক্ষকদের সঙ্গে সরকার উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হতে পারে, সে ব্যাপারে ওই মন্ত্রীরা স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। 

এদিকে একই দাবিতে শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছেন। প্রথম আলোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এতে রাজশাহীর এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ বন্ধ থাকায় অচল হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এই কর্মসূচিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পাশাপাশি আলোচনাও দরকার। এই আন্দোলন কত দিনে থামবে, তা জানি না। কিন্তু এটা জানি “প্রত্যয়” স্কিম থেকে শিক্ষকদের নাম বাতিল এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ছাড়া শিক্ষকদের আর ঘরে ফেরার উপায় নাই।’