স্বপ্নচূড়া জয়ের লক্ষ্যে তাদের এগিয়ে চলা

শিক্ষকদের সঙ্গে রংপুর বিভাগের চ্যাম্পিয়ন পঞ্চগড় বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা—ছোটবেলা থেকেই এটা দেখতে দেখতে বড় হয় পঞ্চগড়বাসী। এর মধ্য দিয়ে শীর্ষে ওঠার স্বপ্ন বুনতে শিখেছে দেশের সর্ব–উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের অনেক মানুষ। বিভাগের শীর্ষস্থান অর্জন করে নিজেদের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে পঞ্চগড়ের সন্তানেরা। ‘মার্কস অ্যাক্‌টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’–এ রংপুর বিভাগের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পঞ্চগড়ের বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়।

এস এম সাফওয়ান

চ্যাম্পিয়ন স্কুলটির দশম শ্রেণির ছাত্র এস এম সাফওয়ান। মাত্র আড়াই বছর বয়সেই দাবায় হাতেখড়ি হয় তার। শুধু সাফওয়ানেরই নয়, তার পুরো পরিবারই দাবা খেলতে ভালোবাসে। ‘আমরা অবসর পেলেই দাবা খেলি। এমন কোনো দিন নেই, আমরা দাবার বোর্ড নিয়ে বসি না। আমাদের বাসায় নতুন কেউ এলে তার মনে হবে দাবার চলমান কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যেই এসেছেন।’ সাফওয়ানের মা গৃহিণী সাবিরা ইয়াসমিনের সরল স্বীকারোক্তি।

এস এম সাদিদ

মূলত বাবার সঙ্গে খেলেই দাবায় হাত পাকিয়েছেন সাফওয়ান। চ্যাম্পিয়ন দলে শুধু সাফওয়ান একাই নয়, সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া তার ছোট ভাই এস এম সাদিদও দাপট দেখিয়েছে। স্কুলশিক্ষক বাবা হকিকুল ইসলামের কাছ থেকেই দাবার প্রতি উৎসাহ পেয়েছে তারা। ঈদের সময় ছেলেদের জন্য শুধু নতুন পোশাক নয়, হকিকুল ইসলাম কিনে দিতেন নতুন দাবার বোর্ডও। নতুন পোশাকের সঙ্গে নতুন দাবার বোর্ড পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে যেত দুই ভাই। বর্তমানে ১২টির বেশি দাবার বোর্ড রয়েছে দুই ভাইয়ের কাছে।

মোস্তাক শাহারিয়ার

তাদের বাবা হকিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাফওয়ান কখনো দাবা খেলায় হারতে চাইত না। একবার জেলায় বড়দের এক দাবা প্রতিযোগিতায় জোর করে নাম নিবন্ধন করে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিযোগিতায় হেরে সাফওয়ানের সে কি কান্না! পরে আলাদাভাবে একটি ম্যাচ আয়োজন করে বয়সে বড় একজনকে হারিয়ে শান্ত হয় সাফওয়ান।’ চ্যাম্পিয়ন দলের সাফওয়ানের দেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা ও ভারতে খেলেছে।

ইরফান সাদিক রাতুল

রংপুর বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দলের আরেক সদস্য মোস্তাক শাহারিয়ারের গল্পটা ভিন্ন। অবসরে লুকিয়ে দাবা খেলতেন তিনি। কারণ, শুরুর দিকে পরিবার থেকে দাবা খেলার ব্যাপারে তেমন সহযোগিতা পেতেন না। ব্যাংকার বাবা জহিরুল ইসলাম সরকারসহ পরিবারের সবার ভয় ছিল, দাবা খেলতে গিয়ে যদি মোস্তাকের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। কিন্তু মোস্তাক শাহারিয়ার দমে যাওয়ার পাত্র নন। পড়াশোনায় ভালো ফল করে জানিয়ে দিলেন, দাবা খেলা তাঁর পড়াশোনায় কোনো ক্ষতি নয়, বরং সাহায্য করে।

নওশীন হানিফী

জহিরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘সবার আগে আমরা ছেলের পড়াশোনাকেই গুরুত্ব দিতাম। কিন্তু দাবা খেলার প্রতি মোস্তাকের ভালোবাসা ছিল প্রচণ্ড। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে দাবা খেলায় মেতে থাকত সে। খেলতে বাধা দিলে কষ্ট পেত। একসময় আমরা খেয়াল করলাম, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে কখনো দাবা খেলে না মোস্তাক। তাই আমরা একপর্যায়ে তাকে উৎসাহই দিয়েছি।’

‘মার্কস অ্যাক্‌টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ রংপুর বিভাগের চ্যাম্পিয়ন দলের ছয় শিক্ষার্থী
ছবি: সংগৃহীত

ক্যাডেট কোচিং করার জন্য আবাসিক একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয় ইরফান সাদিক রাতুলকে। কিন্তু কিছুতেই সেই কোচিং সেন্টারে থাকবে না রাতুল। সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত সে। এ নিয়ে মা–বাবার মধ্যে দুশ্চিন্তা। আবাসিক কোচিং সেন্টারে থাকবে এক শর্তে, তাকে মন ভালো করার একটা কিছু দিতে হবে—এমনটাই আবদার করে রাতুল। শর্ত পূরণ করা হলো। কিনে দেওয়া হলো দাবার বোর্ড। এতেই মন ভালো হয়ে গেল রাতুলের। বন্ধু–সহপাঠীদের সঙ্গে চালিয়ে গেল দাবা খেলার চর্চা। ছোটখাটো জয়ের পর এবার এল বড় সাফল্য। বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় খুশির ঝিলিক তার চোখেমুখে। মেডেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মায়ের কাছে রাতুলের আবদার—মাকেই আবার নতুন করে তাকে মেডেল পরিয়ে দিতে হবে। মা আবদার রাখলেন। তাতেই যেন পূর্ণতা পেল রাতুলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন।

শাহরিয়ার আলম মেজবাহ

চ্যাম্পিয়ন দলের অন্য সদস্য নওশীন হানিফীর দাবার হাতেখড়ি বাবার কাছে। বাবার এক বন্ধু রাশিয়া থেকে ফিরে দারুণ সুন্দর একটি দাবার বোর্ড উপহার দিয়েছিলেন ছোট্ট নওশীনকে। সেই দাবার ঘুঁটি আর বোর্ডই ছিল অবুঝ নওশীনের কান্না থামানোর ‘অস্ত্র’।

দাবার রাজা, মন্ত্রী, নৌকা, ঘোড়া আর পিয়াদা দেখেই শান্ত হতো সে। তবে এখনো দাবার ঘুঁটির সঙ্গে নওশীনের হাসি–কান্না যুক্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক এই খেলায় ঘুঁটির চালে হেরে গেলে ভীষণ মন খারাপ হয় তার। আর যখন জিতে যায়, আনন্দাশ্রু ঝরে। যেমনটা হয়েছিল রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ে নিজের দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর।

পঞ্চগড়ের বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় দাবা দলের সদস্য শাহারিয়ার আলম মেজবাহ ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখত সেরা হওয়ার। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মার্কস অ্যাক্‌টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তার লক্ষ্য জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। দলের অন্য খুদে দাবাড়ুদের মতো মেজবাহও চূড়ান্ত পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বপ্নচূড়া জয়ের লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছে অনুশীলন।