অনেক লোকগান লালনের নামে চালানো হয়: ফরিদা পারভীন

‘বিশ্ব সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বাউল ও লোকদর্শন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ফরিদা পারভীন। শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণকক্ষে
ছবি: প্রথম আলো

একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন বলেছেন, অনেক লোকসংগীত লালন সাঁইজির নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।

আজ শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রশিক্ষণকক্ষে বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থা আয়োজিত ‘বিশ্ব সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বাউল ও লোকদর্শন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

ফরিদা পারভীন আরও বলেন, ‘দুদ্দু শাহ, পান্থ শাহদের আমলে অনেক মরমি কবি ছিলেন, যাঁরা লালনের গান নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বের করতে হবে, কোনটি লালনের গান। এ ক্ষেত্রে উপেন্দ্র ভট্টাচার্যের বাংলার বাউল ও মনির উদ্দিন শাহর লালনগীতির সংকলনকে রেফারেন্স হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।’

বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বাউল শফি মণ্ডলের সভাপতিত্বে সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকায় চীনা দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সিলর লিয়েন উই ও মার্কিন গবেষক কিথ এডওয়ার্ড কান্তে। আলোচক ছিলেন গবেষক তপন বাগচী, আবদেল মান্নান, দেবরাহ জান্নাত ও কাজল কুমার অধিকারী।

কিথ এডওয়ার্ড কান্তে বলেন, সংগীত, সংস্কৃতি, সাধনা কত দিক আছে বাউল দর্শনে। এশিয়ার ভাবদর্শনে লালনের প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর দর্শন বিশ্বের জন্য উপহারস্বরূপ।

‘বিশ্ব সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বাউল ও লোকদর্শন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ফরাসি গবেষক দেবরাহ জান্নাত। শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণকক্ষে
ছবি: প্রথম আলো

লোকসংস্কৃতি গবেষক কাজল কুমার অধিকারী বলেন, ‘কলকাতার গ্রামে গ্রামে রেনেসাঁর প্রসার ঘটিয়েছেন বাউল-কবিরা। বাউলসংগীতের চর্চা যত করা যাবে, মানুষ ততই সুপথের দেখা পাবে। বাউল ও কবিরা মানুষে মানুষে বিভেদ কমিয়েছেন। মানুষের সংস্কৃতি মূলত মিলনের, নানা কারণে আমরা বিভাজিত হয়ে যাই।’

আবদেল মান্নান বলেন, বাউলদের বাণী কোথাও লিখে রাখা হয়নি। ভক্তরা মনে রেখেছে। সুরে সুরে গেয়ে সেসব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বাণী বলে, মানুষকে বাঁচানোই মানুষের ধর্ম, মানুষ মারা নয়।

ফরাসি লালন গবেষক দেবরাহ জান্নাত বলেন, সংগীতের সঙ্গ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। মানুষকে আবারও সঙ্গত করতে কাজ করবে লোকসংগীত। এই সংগীতের চর্চা করতে হলে অবশ্যই ভক্তি নিয়ে করতে হবে। ভক্তিহীন সাধনার কোনো মূল্য নেই।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারপারসন কাকলী ধারা মণ্ডল। ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে মনোরোগের চিকিৎসার পাশাপাশি শারীরিক নানা রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। মেডিকেল সায়েন্সের মানুষেরাও ইদানীং সংগীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলার বাউলসংগীত পেয়েছে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের মর্যাদা। একে সংরক্ষণ এবং এর বিকাশে সকলকে ভূমিকা রাখতে হবে।

‘বিশ্ব সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বাউল ও লোকদর্শন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বাউলশিল্পী ও সাধকেরা। শুক্রবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণকক্ষে
ছবি: প্রথম আলো

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কে এম খালিদ বলেন, রবীন্দ্র, নজরুল, বাউলসংগীতসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এ বৃত্তি চালু হবে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত গবেষণায় অনুদান দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন রুবেল সাইদুল আলম। নিজেদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরে বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থা। এগুলো হলো—বাংলাদেশের বাউল ও লোকগানকে বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার ও সংরক্ষণ, লোক ও বাউল অঙ্গনের সব পদকর্তার জীবন এবং কর্ম তুলে ধরে তাঁদের দর্শন ও সৃষ্টি সর্বজনীনভাবে প্রচার ও প্রকাশ করা, বাউল ও লোকগানের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় জীবনদর্শন তুলে ধরে নানা আঙ্গিকে গবেষণা করে সাধক ও লোককবিদের সৃষ্টি সংরক্ষণ করা, অঞ্চলভিত্তিক ম্রিয়মাণ সাধক কবি ও তাঁদের প্রায় হারিয়ে যাওয়া পদ বা গানগুলো ঠিক রেখে অঞ্চলভিত্তিক বাউলদের সম্পৃক্ত করে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল আর্কাইভ তৈরি করা, দেশ-বিদেশের প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ লোকসাধক, শিল্পী-গবেষক-লেখকদের ওপর তথ্যচিত্র তৈরি করে তা সংরক্ষণ করে তাঁদের জীবনদর্শন ও গায়নশৈলী পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এবং আন্তমহাদেশীয় লোকসংগীতের সাধক ও লোককবিদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে সংগীতের তুলনামূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রদর্শন করে দেশীয় লোকভান্ডার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন লালন গবেষক সরদার হিরক রাজা। সূচনাসংগীত পরিবেশন করেন সমির বাউল। আয়োজকেরা বলেন, দুই দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের লোকগানের প্রশিক্ষণ দেবেন ফরিদা পারভীন, শফি মন্ডল, টুনটুন ফকির, পাগলা বাবলু, সমির বাউল প্রমুখ।