দায়িত্বের বছরপূর্তিতে পিটার হাসের নিবন্ধ
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের কেউ নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান তাঁরা। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনভাবে নিজেদের সরকার নিজেরাই নির্বাচন করুক, এমনটাই চান তাঁরা।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক নিবন্ধে পিটার হাস এসব কথা বলেন।
‘বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে’ শিরোনামের নিবন্ধে পিটার হাস লেখেন—
‘বাংলাদেশের কথা ভাবলেই আমার মনে একটা উপমা চলে আসে। আমি এমন একটি গাড়িতে চড়েছি, যেটা একটা সময়ের ধারা ধরে ছুটে চলছে। আমি যখন গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে তাকাই, তখন আমি অবাক হই যে বাংলাদেশ মাত্র ৫১ বছরে কতটা এগিয়েছে।
আমি এমন একটি বাংলাদেশকে দেখতে পাই, যে দেশটি স্বাধীনতা ও গর্বের সঙ্গে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমি যখন উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনের দিকে তাকাই, তখন আমি আগামী ৫১ বছরে বাংলাদেশ কত দূর যেতে পারে, সেটা কল্পনা করি। আগামী বছরগুলোয় বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই এখানে রয়েছে।
সামনের রাস্তা অবশ্যই মসৃণ ও সোজা নয়। এতে উঁচু, নিচু, গর্ত, বাঁক সবই আছে। অন্য প্রতিটি দেশের মতোই বাংলাদেশকেও গণতন্ত্রকে লালন করতে, শাসনব্যবস্থার উন্নতি করতে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং এর জনগণকে শিক্ষিত করার পদক্ষেপ নেওয়ার সময় সব দিকে নজর রেখে এগোতে হবে।
বাংলাদেশের যাত্রাপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আসন্ন সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে পছন্দের কেউ নেই। তবে আমরা দেখতে চাই যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। আমরা চাই, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সরকার তারাই নির্বাচন করুক। গণতন্ত্রকে সমর্থন করা, ব্যক্তি অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পথ চলা আরও নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে সাহায্য করে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সরকার, গণমাধ্যম থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নাগরিক সমাজ থেকে রাজনৈতিক দল—প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের কেউ যদি নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা তাদের কেউ যদি অন্যকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রত্যেকের আইনের শাসনকে সম্মান করা এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক গতিধারা বজায় রাখতে হবে। গত ২০ বছরে দেশটিতে জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই সংখ্যা প্রায় চার কোটি, যারা দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে, এটি এককথায় অসাধারণ। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের পক্ষে অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব, যদি বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য যতটা সম্ভব আমন্ত্রণমূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করে।
আরও অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে, যদি বাংলাদেশে নিম্নলিখিত সংস্কারগুলো ঘটে:
দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার আরও ব্যবস্থা নেওয়া, তাদের অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া।
এমন একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা, যা ব্যবসা সহায়ক।
দুর্নীতির কারণে গোপন খরচ (লুকানো কর!) ও অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিকতা দূর করা।
সব ধরনের মেধা সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া।
আরও অবাধে মুদ্রা রূপান্তরের অনুমতি দেওয়া।
এই ধরনের ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সংস্কার বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ ও তার জনগণ এই গাড়ি সামনের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আপনারাই ঠিক করবেন, গাড়ি কোন দিকে, কোন গতিতে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র এই যাত্রায় আপনাদের সঙ্গী ছিল এবং ভবিষ্যতেও আপনাদের সঙ্গে পথ চলার সাথি হয়ে থাকবে। আমরা আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে যথাসাধ্য সাহায্য করব।
আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই মহান দেশে আমি আমার দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় বছর শুরুর এই সময়ে আমাদের যৌথ পথ চলা অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।’