বেইলি রোডে আগুন: শুধু নিজেদের গাফিলতি খুঁজে পেল না রাজউক
রাজউকের তদন্ত কমিটি শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতি খুঁজে পেয়েছে।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতি পেয়েছে রাজউকের তদন্ত কমিটি। নিজেদের কোনো গাফিলতি বা দোষ খুঁজে পায়নি তারা। যদিও কোনো ভবন যে উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে, ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তার কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে হচ্ছে কি না, সেটি দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের।
অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ২৭ মার্চ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে রমনা থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, রাজউকের দোকান-পরিদর্শকদের ‘ম্যানেজ’ করে ভবনটিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলছিল। তবে রাজউকের তদন্তে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য উঠে আসেনি।
ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দায় অস্বীকারের সংস্কৃতির কারণে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বিআইপি
কোনো ভবন ব্যবহার করার আগে রাজউকের কাছ থেকে ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর কারণ, রাজউকের অনুমোদন নিয়ে নির্মাণের পরও ব্যবহারবিধি সঠিকভাবে না মানলে একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আগুনে পুড়ে যাওয়া আটতলা গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ ছিল না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রাজউক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবহার সনদ ছাড়াই ১১ বছর ধরে ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছিল। ব্যবহার সনদ না থাকা সত্ত্বেও ওই ভবনের পাঁচটি রেস্তোরাঁকে ব্যবসা করার অনুমতি (ট্রেড লাইসেন্স) দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ভবনের একটি রেস্তোরাঁকে অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত সনদ দিয়েছিল। এ ধরনের অনুমতি দেওয়ার আগে রাজউক অনুমোদিত নকশা ও ব্যবহার সনদ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের ব্যবহার সনদ আছে নাকি নেই, তা দেখার পুরো দায়িত্ব রাজউকের। ফলে রাজউক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। ব্যবহার সনদ নেওয়ার বিষয়ে ভবনের মালিকদেরও আগ্রহ কম। রাজউকেরও তদারকি নেই। ঢাকায় মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ ভবনের ক্ষেত্রে ব্যবহার সনদ নেওয়া নিশ্চিত করা গেছে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের প্রচেষ্টার অভাব যেমন দেখা যায়, তেমনি তাদের অবহেলাও রয়েছে।
ভবনটিতে কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। ভবনটি এক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়, পরে ব্যবহার করা হচ্ছিল অন্য কাজে। ফলে ভবনটি ভয়াবহ ঝুঁকিতে ছিল।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী
রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সিটি করপোরেশন বা ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতির কথা বলা হলেও সংস্থা দুটির কাউকে দায়ী করা হয়নি। পুরো ঘটনার জন্য ভবন মালিক ও রেস্তোরাঁ মালিকদের দায়ী করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
রাজউক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ। তিনি রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ)। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে গতকাল রোববার বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চেয়ারম্যানের (রাজউক) অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
গ্যাস সিলিন্ডারের লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকায় মানুষ চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন
গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের পর সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। পাঁচ সদস্যের এই কমিটি গত সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের চা-কফির দোকানের ইলেকট্রিক চুলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্টসার্কিট) থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকায় মানুষ চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।
বেইলি রোডের আগেও বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা যান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়।
তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটিতে কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। ভবনটি এক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়, পরে ব্যবহার করা হচ্ছিল অন্য কাজে। ফলে ভবনটি ভয়াবহ ঝুঁকিতে ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি বলছে, বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য রাজউক ভবনের নকশা অনুমোদন করলেও এতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু ভবনের বেজমেন্ট (গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান) ছাড়া সব কটি তলায় ছিল রেস্তোরাঁ। এতে ভবনটিতে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়নি। পুরো ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে (তলা), সিঁড়িতে একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন রেস্তোরাঁর ক্যাশ কাউন্টারের (খাবারের বিল পরিশোধের স্থান) পাশেও রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার।
একটি ভবনের নকশা অনুমোদন, নির্মাণ এবং সেটি ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সবকিছু তদারকির দায়িত্ব রাজউকের। কোনো ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও তাদের। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজউকের গাফিলতি সবচেয়ে বেশি।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভবন কর্তৃপক্ষ ব্যবহার সনদের জন্য রাজউকের কাছে কোনো আবেদন করেনি। এ ছাড়া অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ফায়ার সার্ভিসের কাছে ভবন কর্তৃপক্ষ কোনো আবেদন করেনি। শুধু একটি রেস্তোরাঁর মালিক অনেক আগে অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত সনদ নিয়েছিলেন। সেটিও পরে বাতিল করা হয়। ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। অথচ ভবনে দুটি সিঁড়ি থাকার কথা। বেজমেন্টে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে ন্যূনতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসেরও ব্যবস্থা ছিল না। যে কারণে আগুন লাগার পর আটকা পড়ে অনেকের মৃত্যু হয়।
রাজউকের তদন্ত ‘দায়সারা’
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে গত ৯ মার্চ ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে যৌথভাবে মতবিনিময় সভা করেছিল এএলআরডি, আসক, বেলা, ব্লাস্ট, বিলসসহ ১০টি বেসরকারি সংগঠন। সভায় ঢাকায় নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ ও তদারকির ক্ষেত্রে রাজউকসহ সরকারি সংস্থাগুলোর গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছিল। এর আগে গত ৫ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে নগর-পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, আইনজীবী ও পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে উঠে আসে, অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় দুর্ঘটনার পর তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো পারস্পরিক দোষারোপের মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্ব থেকে ‘দায়মুক্তি’ নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গত ৬ মার্চ গোপীবাগে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা দেখি, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে, এক সংস্থা আরেক সংস্থার বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে দায় চাপানোর চেষ্টা করে। তদন্ত হয়, দায়সারা তদন্ত। আইনের আওতায় সুনির্দিষ্ট দায়ভার নির্ধারণের তদন্ত কিন্তু আমরা সচরাচর দেখি না। সুতরাং আমি সবাইকে অনুরোধ করব, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই দুর্ঘটনার দায়ভার নিশ্চিত করার এবং আদালতের মাধ্যমে এর বিচার সম্পন্ন করার। একটি নজির যদি আমরা সৃষ্টি করতে পারি, তাহলেই সবার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে, প্রয়োগ হবে।’
রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মো. আবু নাসেরের সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, ভবনটির ব্যবহার সনদের বিষয়ে রাজউক যা বলছে, এর জন্য দায়ী মূলত তারাই। সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ভবনের নকশা বা নথি চাওয়া হলে রাজউক তা দিতে চায় না।
বেইলি রোডের আগেও বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা যান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আর ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মারা যান ১২৪ জন। এসব ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে।
বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, একটি ভবনের নকশা অনুমোদন, নির্মাণ এবং সেটি ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সবকিছু তদারকির দায়িত্ব রাজউকের। কোনো ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও তাদের। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজউকের গাফিলতি সবচেয়ে বেশি। এ ঘটনায় সবার আগে রাজউক নিজের দায় স্বীকার করে অন্যদের দায় নিরূপণ করা উচিত ছিল। ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দায় অস্বীকারের সংস্কৃতির কারণে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।