আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ইউটিউব চ্যানেলে সবচেয়ে বেশিবার দেখা গানটি আরবি ভাষার। ‘হিরো আলমের অ্যারাবিয়ান ফুল গান’ শিরোনামে গানটি তিনি ইউটিউবে দিয়েছেন এক বছর আগে। দেখা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ বার।
গানের ভিডিওটির নিচে মাজহার নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন এমন, ‘আমার খুব প্রিয় শিল্পী। মন খারাপ হলে তার গান শুনে কিছুক্ষণ বেহুঁশ থাকি।’
কারও কারও মতে, হিরো আলম বেসুরো ভাষায় গান গেয়ে, উদ্ভট সব ভিডিও চিত্র তৈরি করে, ‘ফালতু’ সিনেমা বানিয়ে দেশের সংস্কৃতির সর্বনাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, জাতীয় সংসদকে খাটো করতে বিএনপি হিরো আলমকে উপনির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
‘হিরো আলম এখন জিরো হয়ে গেছে’—বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নৈরাজ্য, অপরাজনীতি ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি সমাবেশে গত শনিবার এটাও বলেছেন ওবায়দুল কাদের।
হিরো আলম ১৯৮৫ সালে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে ডিশ ব্যবসা (কেব্ল টেলিভিশনের সংযোগ) করতেন। পাশাপাশি তিনি গান গেয়ে ভিডিও করে ইউটিউবে দিতেন। ২০১৬ সালে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হন। তাঁকে নিয়ে উপহাস (ট্রল) হয়, সেই উপহাসকে দারুণভাবে ব্যবহার করে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান, আয়রোজগারের ব্যবস্থা করেন।
বাংলাদেশে ২০১২ সালে দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট থ্রিজি ও ২০১৮ সালে ফোরজি চালু হয়। সঙ্গে বাড়তে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহার। জনপ্রিয় হয় ইউটিউব। এসব মাধ্যমের একটি বিশেষ দিক হলো, অর্থ আয়ের জন্য আপনাকে ‘ভালো আধেয়’ (কনটেন্ট) তৈরি করতে হয় না। বেসুরো ভাষার গান, উদ্ভট কাজ, ‘ফালতু’ সিনেমা—এগুলোই বেশিবার দেখা আধেয়র মধ্যে থাকে। যতবার দেখা, ততবার বিজ্ঞাপন, তত টাকা।
হিরো আলম যে বেশ অর্থকড়ি আয় করেছেন, তা দেখা যায় নির্বাচন কমিশনে দেওয়া তাঁর হলফনামায়। চার বছরের ব্যবধানে তিনি কোটিপতি হয়েছেন। গাড়ির মালিক হয়েছেন। কিনেছেন ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও।
যা–ই হোক, সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল। বাদ সাধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তারা হিরো আলমকে ‘তুলে নিয়ে’ মুচলেকা নেয় বলে দাবি করেন তিনি। কী ছিল সেই মুচলেকায়, হিরো আলমের ভাষ্য, তিনি রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গাইবেন না এবং পুলিশের পোশাক ব্যবহার করবেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন।
বগুড়ায় উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন হিরো আলম। তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সংসদ নাকি ‘খাটো’ হয়ে যেত। প্রশ্ন হলো, শুধু জাতীয় সংসদ নয়, দেশকে, দেশের মানমর্যাদার প্রতিষ্ঠানকে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে, রাজনৈতিক দলকে হিরো আলম ছাড়া কি কেউ খাটো করেননি? কেউ কি খাটো করছেন না?
উত্তর হলো, করেছেন ও করছেন। আসুন দেখে নিই হাস্যকর অথবা ‘ইমেজ’ নষ্টের ৯টি কাজ, যা হিরো আলম করেননি—
১. ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তবে ভোটের আগে নির্বাচিত হয়ে যান ১৫৩ জন, যাঁদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ফলে মানুষ আগে থেকেই জানত, ভোটের ফলাফল যা–ই হোক, সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ভোটের নামে এমন পরিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসে (গণতান্ত্রিক আমল) আর সংগঠিত হয়নি।
বাংলাদেশের সেই প্রহসনের নির্বাচন তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল। ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দুর শিরোনাম ছিল, ‘কেউ জেতেনি বাংলাদেশে’ (৯ জানুয়ারি, ২০১৪)।
সব মিলিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের যে ঘটনা ঘটেছিল, তাতে হিরো আলমের কোনো দায় নেই। রাজনৈতিক দল, সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—কারও সঙ্গে হিরো আলমের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। জানামতে, তিনি ব্যস্ত ছিলেন বগুড়ায় ‘ডিশ ব্যবসা’ নিয়ে।
২. ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের সবচেয়ে বড় কাজটি হয়েছিল ২০১৪ সালেই। ওই বছর ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আর সংসদে বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি, যাদের বলা হতো ‘গৃহপালিত’। জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়েছিলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ হয়েছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটির তিনজন নেতা মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
সরকারের অংশ হওয়া ও বিরোধী দল হওয়া—দেশের সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের এই কাজে হিরো আলম শুধু দর্শকই ছিলেন।
৩. ২০১৮ সালের ভোট
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশে একাদশ জাতীয় সংসদের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো হয়নি। কারণ, এতে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তবে অভিযোগ আছে যে এই নির্বাচনে ভোটের আগের দিন রাতে ভোট হয়ে যায়। এটি পরিচিতি পায় ‘রাতের ভোট’ হিসেবে, যা দেশের নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রয়াত মাহবুব তালুকদার। তিনি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসির সাংবাদিক প্রকাশ করেছেন। এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।’
২০২২ সালের ৩১ জুলাই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের ভোট নিয়ে বলেছিলেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি, কী বলব, এটা হয়।’ জাপানের বিদায় নেওয়া রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যেও এসেছিল রাতের ভোটের কথা।
যা–ই হোক, হিরো আলম রাতের ভোট নিয়ে এখনো কিছু বলেননি। তাই রাতের ভোটের মাধ্যমে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের দায় তাঁর ওপর বর্তায় না।
৪. ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় বাস
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় বাস। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার তখনকার সভাপতি আবদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ঢাকার বাস দেখলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে হয়—দরিদ্র, মধ্যম আয়, নাকি উন্নত? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। আমার অত্যন্ত বেদনা বোধ হয় এবং লজ্জা লাগে। এটাই কি আমাদের নিয়তি ছিল?’
এই লজ্জার দায় আবদুল হকের নয়, বাংলাদেশের মানুষের নয়, হিরো আলমেরও নয়।
৫. বায়ুদূষণ
দুটি বৈশ্বিক তালিকায় ঢাকার নাম নিয়মিতই থাকে। একটি হলো যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের বাসযোগ্য শহরের তালিকা। ২০২২ সালের তালিকায় ১৭২টি শহরের মধ্যে ঢাকা ছিল ১৬৬তম, অর্থাৎ বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে তলানিতে থাকা একটি নগর বাংলাদেশের রাজধানী।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় ঢাকায় প্রায়ই ১ নম্বরে থাকে।
ঢাকাকে বায়ুদূষণের শীর্ষ তালিকায় নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, উদাসীনতার। তারা জনবল না থাকা, অর্থ বরাদ্দ না থাকা, সরকারি অন্য সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাসহ নানান অজুহাত তুলে ধরতে পারবে। তবে এটা বলতে পারবে না যে এ জন্য হিরো আলম দায়ী।
৬. বইমেলায় বই নিষিদ্ধ
অমর একুশে বইমেলায় এবার একটি বইয়ের প্রবেশ ঠেকিয়েছে বাংলা একাডেমি। আদর্শ প্রকাশনীর বইটির নাম ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’, যার লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম। অবশ্য এই নিষিদ্ধের মাধ্যমে বইটি বেশি প্রচার পেয়েছে।
বইমেলায় বই নিষিদ্ধের খবরটি ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম এএফপির প্রতিবেদনে এসেছে। সরকার যে বই নিষিদ্ধ করেনি, সেটা বইমেলায় প্রবেশ ঠেকানো ও বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ফলে বইমেলার যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তার সঙ্গে হিরো আলম জড়িত ছিলেন না।
৭. ভোটের মাঠ থেকে প্রার্থী হাওয়া
নতুন নির্বাচন কমিশনের আমলে গত বুধবার অনুষ্ঠিত ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে। সেখানে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছিল আওয়ামী লীগ। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা ছিল আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আশুগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদের। তবে ভোটের কয়েক দিন আগে তিনি নিখোঁজ হন। ভোট শেষ হওয়ার পরদিন তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়।
আবু আসিফের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় নতুন নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর জন্য কোনোভাবেই হিরো আলমকে দায়ী করা যাবে না।
৮. ‘খেলা হবে’ স্লোগান
‘খেলা হবে’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সেটি পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। এখন আবার কলকাতা হয়ে স্লোগানটি এসেছে ঢাকায়। ব্যবহার করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ‘খেলা হবে’ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান হতে পারে না। কেউ কেউ মনে করেন, দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মুখে এই স্লোগান শোভা পায় না। এটা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
৯. শিল্পী সমিতির নির্বাচন
দেশের শিল্পীদের একটি সমিতি আছে। সেই সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে অভিনেতা জায়েদ খান ও অভিনেত্রী নাসরিন আক্তার নিপুণ আদালত পর্যন্ত গিয়েছেন। দেশে ভালো সিনেমা না থাকা, সিনেমার নামে ভাঁড়ামির মধ্যে শিল্পী সমিতির নির্বাচন–বিতর্ক মানুষকে হাস্যরসের জোগান দিয়েছে। শিল্পী সমিতিতে হিরো আলমের সদস্য পদ নেই।
হিরো আলমের গান সুরের হয় না, তাতে ক্ষতি নেই, কেউ আপনাকে বাধ্য করছে না সেই গান শুনতে। হিরো আলমের সিনেমা ফালতু, তাতে ক্ষতি নেই, কেউ আপনাকে বাধ্য করছে না সেই সিনেমা দেখতে। হিরো আলমের আধেয় অরুচিকর, তাতে ক্ষতি নেই, কেউ আপনাকে বাধ্য করছে না সেই আধেয় পয়সা দিয়ে কিনতে।
কিন্তু দেশে নির্বাচনটা সুষ্ঠু না হলে আপনার ক্ষতি, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে আপনার ক্ষতি, ‘ভোট রাতে’ হলে আপনার ক্ষতি, বায়ু দূষিত হলে আপনার ক্ষতি। এই যে নির্বিচার গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দেওয়া হচ্ছে, এসবই আপনাকে চাপে ফেলছে।
ভোটটা দিনে হলে, আপনার ভোট আপনি দিতে পারলে রাজনীতিবিদেরা আপনার কথা ভাবতে বাধ্য হবেন।