বিজয়ের মাসে প্রথমা প্রকাশনের আয়োজনে বই, আলোচনা, গান, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হলো বিজয় বইমেলা। বাংলা একাডেমির চত্বরে প্রতিদিন সকাল থেকেই ছিল বইপ্রেমীদের আগমন। বিকেলে মেলামঞ্চের অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি শীতের আবহে পিঠাপুলি আর গরম চা-কফির সঙ্গে বই ও লেখালেখি নিয়ে আড্ডায় মেতে সময় কাটিয়েছেন তাঁরা। বছর শেষের এই বইমেলায় পাঠকের মনে রইল আসন্ন অমর একুশে বইমেলায় ভালো মানের বই পাওয়ার প্রত্যাশা।
আজ শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিজয় বইমেলা মঞ্চে সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় জীবনের বড় দুর্ভাগ্য, স্বাধীন হয়েও আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারিনি। যে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, তা সবার জন্য বণ্টন করতে পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দুটি কাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল। প্রথমটি হলো নিজেরা নিজেদের শাসন করব, আমাদের গণতন্ত্র থাকবে। দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের অর্থনৈতিক ভাগ্য থাকবে। একের পর এক সামরিক–বেসামরিক শাসক এল–গেল, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো না। সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু লোকের আর্থিক ভাগ্য ভালো হলেও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তন হলো না। তবে এখন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে আবার একটি সুযোগ এসেছে। ইতিহাসের সকল অধ্যায় স্মরণ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনসাধারণের অর্থনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।’
বইমেলা প্রসঙ্গে হাসনাত আবদুল হাই বলেন, বছরে কেবল একবার বড় করে বইমেলা করা নয়, মাঝেমধ্যেই বইমেলা হওয়া উচিত। যারা দেশের প্রধান প্রকাশক, তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বইমেলা করতে পারে। এতে যাঁরা বই কিনতে চান, তাঁরা সহজে পছন্দের বই পাওয়ার সুযোগ পাবেন। পাঠকেরও আগ্রহ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে তিনি জনপ্রিয় বইয়ের পাশাপাশি অজনপ্রিয়, কিন্তু জ্ঞান–বিজ্ঞান, চিন্তা, সৃজনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এমন বইও প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রথমা প্রকাশনকে এই বইমেলা আয়োজনের জন্য তিনি ধন্যাবাদ জানান।
সমাপনী অনুষ্ঠানের আলোচনার বিষয় ছিল ‘দেশ, মানুষ, লেখালেখি’। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসন চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে। এটা করতে গিয়ে তারা গণতন্ত্র, জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা, পরিবেশ, প্রকৃতি—সবকিছু বিপর্যস্ত করেছে। তবে এ দেশের মানুষ কখনো হাল ছাড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তাদের মনে যে সাহসের সঞ্চার করেছে, সেই সাহস নিয়েই এবার তারা শেখ হাসিনার কঠিন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে কিছু করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রত্যাশা ছিল, তার অনেক কিছুই হয়তো পাওয়া যায়নি। অনেক কিছু অপূর্ণতা আছে। সে কারণে অনেক লড়াই করতে হয়েছে, ভবিষ্যতেও করতে হবে। কিন্তু আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হবে দেশের প্রাণ, প্রকৃতি, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গসহ যত বৈচিত্র্য রয়েছে, তার পক্ষে থেকে সব ধরনের বৈষম্য অবসানের জন্য সংগ্রাম করা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্ম যেসব গ্রাফিতি এঁকেছে, তাদের কাঁচা হাতের লেখায় এই বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ ও বৈষম্যের কথাই প্রধান হয়ে উঠে এসেছে। যত গান রচনা করা হয়েছে, তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, কবিতা লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, তার মূল তাৎপর্যও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৈষম্যের অবসান করা।’
লেখক ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক উম্মে ফারহানা বলেন, শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক লেখকদেরই প্রাধান্য না দিয়ে দেশের সব এলাকার লেখকদের সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, যে নারীরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের ‘নারী লেখক’ হিসেবে চিহ্নিত না করে সামগ্রিকভাবেই একজন লেখক হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে লেখকের প্রাপ্য সম্মানী প্রদানের নিশ্চয়তার বিষয়টিতে তিনি জোর দেন। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশাগত কাজ, তারপরে সংসারের দায়িত্ব পালন করে কথাসাহিত্যের চর্চার পর্যাপ্ত সময় বের করা অনেক কষ্টকর।
কবি ও কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী তাঁর আলোচনায় দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নিরপেক্ষ এবং সর্বসম্মত বয়ান তৈরির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে যে দল যখন ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই দল তাদের নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয় ইতিহাসের বয়ান তৈরি করেছে। আগের ইতিহাস বাতিল করে দিয়েছে। এমনকি স্কুল–কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও ইতিহাস নিয়ে এই বিবিধ বয়ান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা সত্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তারা কেবলই বিভ্রান্ত হয়েছে। ইতিহাসের নিজস্ব বয়ান তৈরির এই প্রবণতা সমাজে দ্বন্দ্ব ও অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করেছে। এর অবসান হওয়া দরকার।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে কবিতা আবৃত্তি করেন জাভেদ হুসেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে শিল্পী জোয়ান বায়েজের গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ যেখানে দিন শেষ’ ও সলিল চৌধুরীর লেখা ‘সেদিন আর কত দূরে’ গেয়ে শোনান শিল্পী ওয়ার্দা আশরাফ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সঞ্চালক প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘এই বইমেলা মঞ্চে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেশের গুণীজনেরা যেসব মূল্যবান আলোচনা করেছেন, তাতে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নতুন চিন্তার উদ্রেক হয়েছে, অনেক অজানা তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি মেলা থেকে পাঠকেরা তাঁদের পছন্দের বই সংগ্রহ করেছেন। প্রথমা প্রকাশন ২০০৯ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে বিচিত্র বিষয়ে দুই শতাধিক লেখকের প্রায় ৮৯০টি বই প্রকাশ করেছে। ভালো বই প্রকাশে প্রথমার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।’
প্রথমার বিজয় বইমেলা শুরু হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর। এতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে এইচএসবিসি ব্যাংক।