তাঁরা হজে ছিলেন, তবু ‘গায়েবি’ মামলার আসামি

চন্দনাইশ ও হাটহাজারীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আরও দুই মামলা। বাদী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা।

পবিত্র হজ পালনের জন্য দেড় মাস সৌদি আরবে ছিলেন চট্টগ্রামের দুই বিএনপি নেতা। তাঁরা ফেরেন গত ৩০ জুলাই। অথচ ২৮ জুলাই এক যুবলীগ নেতার করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আগের দিন সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে হজে থাকা ওই দুজনসহ ১২০ জন মিলে তাঁকে মারধর করেছেন। ওই সময় তাঁদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা ও পেট্রলবোমা।

বিশেষ ক্ষমতা ও বিস্ফোরক আইন এবং ভাঙচুর-মারধরের অভিযোগে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানায় এই মামলা হয়েছে। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ জুলাই দুপুর সোয়া ১২টা। ঘটনাস্থল পৌরসভার গাছবাড়িয়া এলাকা। মামলার বাদী চন্দনাইশ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। হজে থাকা বিএনপির দুই নেতা হলেন চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী ও সাইফুল করিম।

অন্যদিকে ২৭ জুলাই হাটহাজারী থানায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইন ও ভাঙচুর-মারধরের অভিযোগে আরেকটি মামলা হয়েছে।এ মামলার বাদী চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আয়মান আওসাফ চৌধুরী। তিনি হাটহাজারী সদরের বাসিন্দা। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১২১ জনকে।

বাদী ও আসামিরা সবাই স্থানীয়। এতে সামাজিকভাবে অস্থিরতা বাড়বে।
আখতার কবির চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক

দুটি মামলায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হননি। চন্দনাইশ ও হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা ঘটনার তদন্ত করছেন।

বিএনপির নেতাদের দাবি, এসব ‘গায়েবি মামলা’। দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান বলেন, এসব গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করা।

এর আগে ১৪ জুলাই পটিয়া ও ২২ জুলাই লোহাগাড়ার দুটি মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ৪০ জনকে। তাঁরা সবাই স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। এ ছাড়া দুই মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ৩২০ জনকে। দুটি মামলার এজাহারের বর্ণনা ছিল একই। এ নিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হলো চারটি। এতে মোট আসামি ৬২১ জন।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে এ রকম অসংখ্য মামলা করেছিল পুলিশ। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় নাশকতার অভিযোগে মামলা হয়েছিল ২৩২টি।

আরও পড়ুন

সৌদি আরব থেকে চন্দনাইশে হামলা

‘মক্বামে ইব্রাহিম হজ কাফেলার’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএনপি নেতা মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী গত ১৮ জুন পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে যান। তাঁর সঙ্গে একই কাফেলায় হজে যান বিএনপির আরেক নেতা সাইফুল করিম।

যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেনের করা মামলার এজাহারে বিএনপির নেতা মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী, সাইফুল করিমসহ ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারে তিন নম্বর আসামি মঞ্জুর মোর্শেদ আর সাইফুল করিম চার নম্বর। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রাখা হয় ৮০ জনকে।

৩০ জুলাই সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে আটজনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। দিনের বেলার ওই ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় কেউ কিছু জানেন না বলে জানান। ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো দোকানপাট নেই। পুলিশ সেই দিন ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি পেট্রলভর্তি কাচের বোতল, বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে জব্দতালিকা তৈরি করে। এই তালিকায় থাকা সাক্ষী মো. আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিছু জানেন না। পুলিশ সই করতে বলেছে।

আরও পড়ুন

মামলার অপর আসামি পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইকতিয়ার উদ্দিন দাবি করেন, সেদিন তাঁরা কোনো মিছিল-সমাবেশ করেননি।

হজে যাওয়া মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে গতকাল দুপুরে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ৩০ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৫৯৬ উড়োজাহাজে করে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে পৌঁছান। তাঁর কাফেলায় হজে গেছেন সাইফুল করিম। তিনি একই দিন রাতে বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৯৬০ ফ্লাইটে দেশে ফেরেন। হজে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন সাইফুল করিম।

মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে বাদী ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে’। এরপর আর কোনো উত্তর না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

বিস্ফোরণের শব্দ শোনেননি কেউ

হাটহাজারীতে করা মামলার এজাহারে ২৬ জুলাই রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কের চারিয়া বোর্ড স্কুল বাজারে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও কোনো শব্দই শুনতে পাননি বলে জানান আশপাশের দোকানদার ও বাসিন্দারা।

প্রথম আলো ২৯ জুলাই রাতে দোকানদারসহ ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা কিছুই জানেন না। কিন্তু মামলার এজাহারে বলা হয়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে সড়কে মিছিল করেন। পরে পুলিশ টিনের কৌটাসদৃশ বিস্ফোরক ককটেলের অংশবিশেষ, লাঠিসহ বেশ কিছু আলামত জব্দ করে। জব্দতালিকার সাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা এ বি এম আতাউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ তাঁকে জব্দতালিকায় সই করতে বললে সই করেন।

মামলার বিষয়ে জানতে বাদী ছাত্রলীগ নেতা আয়মান আওসাফ চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা বলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আরও পড়ুন

হাটহাজারী উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব গিয়াস উদ্দিন দাবি করেন, মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই তিনিসহ ২৩ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দলীয় কর্মসূচি পালন করতে ঢাকায় ছিলেন। চট্টগ্রামে ফেরেন ৩০ জুলাই।

এ ধরনের মামলা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবাদ, হানাহানি আরও বাড়াবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাদী ও আসামিরা সবাই স্থানীয়। এতে সামাজিকভাবে অস্থিরতা বাড়বে।