সুন্দরবনে বেড়াতে গেলে একটি নারী মূর্তি পর্যটকদের চোখে পড়বেই। গরিব বনজীবীদের গড়ে তোলা বলে খুব জমকালো নয়। নাম তার বনবিবি। বনবিবির সামনে ভক্তদের নিবেদনের প্রমাণ হিসেবে পড়ে থাকে কলা, তেলের শিশি বা কচি ডাব। কখনো কখনো আবার নতুন গামছাও।
বনঘেঁষা জমিতে গোলপাতার সামান্য ছাউনিতেই তৈরি হয়ে যায় বনবিবির থান। অবস্থাপন্ন বনজীবী থাকলে তাঁরা টিন দিয়ে আচ্ছাদন করে দেন। কোনো কোনো বনজীবীর কাছে তিনি বনের আপদ থেকে রক্ষাকারী। বনবিবি সুন্দরবন ঘিরে কয়েক শ বছর ধরে চলে আসা এক লৌকিক বিশ্বাসের নাম। বনবিবির বহরে থাকে দুখে, ধনাই, মনাই আর ভাই শাহ জাঙ্গুলি। বনের বাওয়াল, মৌয়াল, জেলের কাছে বনবিবি বনের অধিকর্ত্রী। তাঁরা সুর করে করে বনবিবির উদ্দেশে গাইতে থাকেন, ‘কাঁচা কাষ্ঠ, ফাটা হাঁড়ি/ কেমনে ভাত রাঁধব আমি/ বনবিবি মা, আমায় উপায় বলো না…’
এ গান গাওয়া হয় বনবিবির পালায়। বনবিবির নামে মানত করেন তাঁরা। পুঁথি পড়ে ভক্ত তাঁকে নিবেদন করেন নিজের মানত। এই যে পুঁথি তাঁরা পড়েন, তার নাম বোন বিবি জহুরানামা।
বাংলাদেশের বাগেরহাট, খুলনার দাকোপ, কয়রা আর সাতক্ষীরার কয়েকটি জায়গায় মাঘ মাসে প্রতিবছর বনবিবির মেলা হয়। মেলার আগে দিনভর চলে পুঁথিপাঠ। এই পুঁথি বনজীবীদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ। নতুন করে আর প্রকাশিত হয় না বলে পুঁথিটিকে দুষ্প্রাপ্য বলা যায়। প্রয়াত মুনশী মোহাম্মদ খাতের পুঁথিটি রচনা শেষ করেছিলেন বাংলা ১২৮৭ সনের ৭ কার্তিক।
প্রায় দেড় শ বছর আগে এর যে কপিটি আমাদের কাছে আছে, তার গায়ের মূল্য ‘এক টাকা মাত্র’। পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র ৪৩। পড়তে হয় বাঁ দিক থেকে। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে ভাগ ভাগ করে পড়ার নিয়ম। শেষ পৃষ্ঠায় কোনো এক নুরউদ্দিন আহমদ লিখে রেখেছেন বইটির ওপরে তাঁর স্বত্বাধিকারের কথা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সর্বসাধারণকে জানাইতেছি যে আমার অনুমতি ভিন্ন এই পুস্তক কেহ ছাপিলে তাহাকে আইনমতে অপরাধী হইতে হইবে ও আমার খেসারতের দাবি বুঝিয়া দিতে হইবে।’
২০২০ সালে এই প্রতিবেদক খুলনার লোক-গবেষক বাসুদেব বিশ্বাসের কাছ থেকে পুঁথিটি সংগ্রহ করেছিলেন।
কয়রার সুন্দরবনঘেঁষা দক্ষিণ বেদকাশির জোড়শিং গ্রামে এখনো প্রতিবছর মাঘ মাসে মেলা বসে। এখানকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন রণজিৎ সরকার।
২০০৪-০৫ সালের দিকে স্কুলে পড়ানোর সময় কয়েকবার বনবিবির মেলায় গেছেন তিনি। বাসুদেবের অনুরোধে তিনি জোড়শিং গ্রামের এক বনজীবী পরিবারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন পুঁথিটি। রণজিৎ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় এক মাঝির সঙ্গে দীর্ঘদিন আলাপ করে বুঝিয়েছিলাম কেন পুঁথিটি চাই। তিনি জোড়শিং গ্রামে যে বাড়িতে পুঁথি পড়া হয়, তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে এনে আমাকে দিয়েছেন। তাঁদের কথা দেওয়া আছে, কোনোভাবে এর অমর্যাদা হতে দেব না।’ পুঁথির গায়ে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা আছে ‘সুভাষ মণ্ডল, গ্রাম-জোড়শিং’।
পুঁথিটির ১২টি পর্ব। যেমন নারায়ণীর জঙ্গ, ধোনা দুঃখের পালা, বোন বিবী-শা জঙ্গলির পয়দায়েশের বয়ান, গোল বিবীর সহিত বেরাহিমের শাদির বয়ান ইত্যাদি। পুঁথিতে রায়মঙ্গল নদ, কেঁদোখালী, হাসনাবাদের মতো বহু জায়গার উল্লেখ আছে। সুন্দরবন ঘুরে আসা পর্যটকেরা সহজেই চিনে ফেলতে পারবেন।
যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের লেখক এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র এ পুঁথির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, বনবিবি বেরাহিম নামে এক আরব দেশির কন্যা। যশোরের ব্রাহ্মণ নগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনে ভাটির দেশের রাজা ছিলেন দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতকের অবিভক্ত সুন্দরবনে পুঁথির অনুরূপ চরিত্রগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব ছিল।
বোন বিবী জহুরা নামা পুঁথির ভাষায় বাংলার সঙ্গে মিশে আছে আরবি আর ফারসি। সুন্দরবন অঞ্চলে এখনো বনে কাঠ বা মধু সংগ্রহ করতে যাওয়াকে অনেকেই ‘মহাল’ বলে থাকেন। দেড় শতাব্দী বয়সী এই পুঁথিতেও শব্দটি পাওয়া যাবে। ‘জহুরা’ শব্দের অর্থ ‘কৃতিত্ব’। এ পুঁথিতে তো বনবিবির কৃতিত্বেরই বর্ণনা।
বনবিবির পুঁথিই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্বনন্দিত কথাসাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষের ইংরেজি উপন্যাস জঙ্গলনামার বয়ানের ভিত্তি। খুলনার লোক-গবেষক বাসুদেব বিশ্বাসের কাছ থেকে বনবিবির সেই পুঁথি সংগ্রহের পর অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, বোন বিবী জহুরা নামা কেবলই একটি কাব্য নয়। এ ধরনের লোককথায় সাহিত্যগুণের সঙ্গে রয়েছে একটি সময়ের ভৌগোলিক পরিবেশ, জলবায়ু ও আর্থসামাজিক অবস্থানের চিত্র।
পুঁথিটি নিয়ে গবেষণা করেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রঞ্জন রপ্তান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুদ্রণ নেই বলে পুঁথিটি পাওয়া যায় না। এ পুঁথি বাংলার অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার এক উজ্জ্বল নজির।